![]()
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সাম্প্রতিক ১২ দিনের যুদ্ধ আঞ্চলিক উত্তেজনাকে নতুন মাত্রায় উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে। এই সংঘর্ষে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) একাধিক কৌশলগত হামলার দাবি করেছে, যার মধ্যে মোসাদের একটি কেন্দ্রীয় স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে ৩৬ জন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছেন আইআরজিসির মুখপাত্র ও জনসংযোগ বিভাগের উপপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলি–মোহাম্মদ নাঈনি।
রোববার ছাত্র দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি যুদ্ধ চলাকালীন ইরানের সামরিক প্রতিক্রিয়ার বিবরণ তুলে ধরেন। নাঈনি জানান, যুদ্ধ শুরুর পরপরই ইরান সমন্বিত সামরিক প্রতিক্রিয়া শুরু করে—যা শুধু সাধারণ প্রতিশোধ নয় বরং বহুস্তরীয় প্রযুক্তি, গোয়েন্দা তৎপরতা ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের সমন্বিত প্রয়াস ছিল।
হাইফা রিফাইনারিতে ‘মাস্টারপিস’ হামলা
নাঈনি বলেন, তেহরানে ইসরায়েলের জ্বালানি ডিপোতে হামলার পর মাত্র পাঁচ ঘণ্টার ব্যবধানে ইরান হাইফা রিফাইনারিতে দুটি শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইসরায়েলি সূত্রগুলো এই হামলাকে ‘‘ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের মাস্টারপিস’’ বলে উল্লেখ করেছে। হামলায় রিফাইনারিটি অচল হয়ে যায়, ফলে ইসরায়েলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি–অবকাঠামো ভেঙে পড়ে।
মোসাদের কেন্দ্রকে লক্ষ্য করে পাল্টা আঘাত
এরপর ইসরায়েলের একটি গোয়েন্দা স্থাপনায় হামলার জবাবে ইরান নিজেদের পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে মোসাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র লক্ষ্যবস্তু করে। নাঈনির দাবি অনুযায়ী, ওই হামলায় কমপক্ষে ৩৬ জন নিহত হয়।
এ ঘটনাটি যুদ্ধকালে সবচেয়ে আলোচিত হামলাগুলোর একটি, যা ইসরায়েলের গোয়েন্দা কাঠামোর দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
‘ট্রু প্রমিজ ৩’: ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার থেকে ড্রোন—বহুস্তরীয় অভিযান
নাঈনি জানান, ‘‘ট্রু প্রমিজ ৩’’ নামে ইরানের সামরিক অভিযান যুদ্ধ শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চালু করা হয়। এ অভিযানে
-
ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার,
-
সাইবার আক্রমণ,
-
স্বল্প ও দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র,
-
ড্রোন হামলা
সহ আধুনিক সামরিক প্রযুক্তির সমন্বয় ছিল। তার দাবি—ইরান গোটা যুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্যের পূর্ণ আধিপত্য বজায় রাখে, এবং ব্যাপক ডেটাব্যাংকের সহায়তায় শত্রুপক্ষের প্রতিটি পদক্ষেপ পূর্বাভাস করতে সক্ষম হয়।
৩২ তলা ভবনের মাইনাস–১ তলায় হামলা: নির্ভুল আঘাতের দাবি
নাঈনি আরও বলেন, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র এতটাই নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে যে অধিকৃত ফিলিস্তিনের একটি ৩২ তলা ভবনের ভূগর্ভস্থ (মাইনাস-১) স্তরে অবস্থিত স্টক এক্সচেঞ্জ ডেটা সেন্টারও ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে।
এই দাবি সামরিক মহলে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে—অধিকাংশ বিশ্লেষকের মতে এটি আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির নতুন বাস্তবতা নির্দেশ করে।
ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যর্থ: ইরানি দাবি
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একযোগে তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করেও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে ব্যর্থ হয়েছে বলে নাঈনি দাবি করেন। তার ভাষায়, ‘‘ইসরায়েল যেখানে বৃহৎ হামলার সতর্কতা দিয়েছিল, সেখানে ইরানের একটি ক্ষেপণাস্ত্রই প্রত্যাশার তুলনায় বহু গুণ বেশি ক্ষতি করেছে।’’
তরুণ বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা ও জনগণভিত্তিক যুদ্ধনীতি
নাঈনি জানান, ইরান–ইরাক যুদ্ধের পর ইরানের প্রতিরক্ষা কৌশল জনগণভিত্তিক ও অসম যুদ্ধনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ইরানের তরুণ সামরিক ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা এই যুদ্ধে অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন—যা দেশের ভবিষ্যৎ প্রতিরক্ষা নীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।
১২ দিনের যুদ্ধ—একটি নতুন কেস স্টাডি
তার মতে, টানা ১২ দিনের এই যুদ্ধ সামরিক বিশ্লেষকদের জন্য ‘‘একটি বিশেষ কেস স্টাডি’’ হয়ে থাকবে। দ্রুত কমান্ড পুনর্গঠন, টানা ২২ দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও কৌশলগত উদ্যোগ পুনরুদ্ধার—এসবই যুদ্ধের মোড় ইরানের পক্ষে ঘুরিয়ে দেয়।
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই সংঘর্ষ আবারও দেখিয়ে দিল—মধ্যপ্রাচ্যে যে কোনো সামরিক উত্তেজনা হাজারো মানুষের জীবনে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাই শান্তি ও সংলাপের আহ্বান আরও জোরালো হয়ে উঠেছে।
পাঠকের মন্তব্য