![]()
দীর্ঘদিন ধরেই বড় মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এ ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখনও গুরুতরভাবে অপর্যাপ্ত। শুক্রবার সকালে দেশ সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র—রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার—ভূমিকম্প অনুভব করে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ‘বড় ধরনের ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা’ হিসেবে দেখছেন। গতকালও তিন দফা ভূকম্পন অনুভূত হয়।
আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে—বড় ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশে প্রায় ৩৪৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে। আর সারা দেশের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন প্রতিস্থাপনে প্রয়োজন হতে পারে ৩৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির ৭৭ শতাংশের সমান। বিশ্লেষকদের মতে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে ভয়াবহ মানবিক ও আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে দেশ।
ইতালিভিত্তিক গ্লোবাল আর্থকোয়াক মডেলিং (জেম) ফাউন্ডেশন জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ২০২৩ সালে প্রকাশিত ‘ভূমিকম্পে দুর্বলতা এবং বাংলাদেশে পদ্ধতিগত ঝুঁকি মূল্যায়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানায়—বাংলাদেশ ও আশপাশের সক্রিয় ফল্ট লাইন থেকে উদ্ভূত ভূমিকম্পে দেশের দুর্বলতা অত্যন্ত বেশি। জেলার পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে বিস্তারিত ভূমিকম্প ঝুঁকির মডেল তৈরিই ছিল গবেষণার মূল লক্ষ্য। এতে বলা হয়, দেশের অধিকাংশ ভবন ভূমিকম্প প্রতিরোধী নকশায় তৈরি নয়, অপ্রকৌশলগত কাঠামোর আধিক্য ও বিল্ডিং কোড উপেক্ষা এবং সহজে তরলীকরণযোগ্য নদীবিধৌত মাটিই বিপদ বাড়িয়েছে।
গবেষণা অনুযায়ী, দেশের সাত অঞ্চলে মোট ২ কোটি ৯০ লাখ ভবনের মূল্য নির্ধারণ করা হয় সর্বোচ্চ ৩৪৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জিডিপির ৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকার ৯০ লাখ ভবন প্রতিস্থাপনে প্রয়োজন ১৪৯ বিলিয়ন ডলার এবং চট্টগ্রামের ৫০ লাখ ভবন প্রতিস্থাপনে প্রয়োজন ৬২ বিলিয়ন ডলার। রাজশাহীর ৪০ লাখ ভবনে খরচ ৪২ বিলিয়ন, খুলনার ৩০ লাখ ভবনে ৩৪ বিলিয়ন এবং রংপুরের ৪০ লাখ ভবনে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। সিলেট ও বরিশালের ২০ লাখ করে ভবনের প্রতিস্থাপন ব্যয় ১৭ বিলিয়ন ডলার।
সিসমিক ঝুঁকি বিশ্লেষণে দেখা যায়—উত্তর ও পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সক্রিয় ফল্ট লাইনের কাছাকাছি অঞ্চলগুলো সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন।
ঢাকা অঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের মূল্য ৬৯.৮–১৬৭.৯ বিলিয়ন ডলার, চট্টগ্রামে ৪৭.৮–৬৯.৮ বিলিয়ন, রাজশাহীতে ৩৯.১–৪৭.৮ বিলিয়ন, রংপুর ও খুলনায় ১৯.৪–৩৯.১ বিলিয়ন এবং সিলেট–বরিশালে ১৮.৯–১৯.৪ বিলিয়ন ডলার।
এ গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ফায়ার সার্ভিস, ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর, পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে কারিগরি প্যানেল কাজ করেছে। এ প্যানেলের সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ূন আখতার ও অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী গবেষণাকে যথাযথ বলেছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কেএম আবদুল ওয়াদুদ বলেন, “ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নেই, তাই প্রস্তুতিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী ঝুঁকির পরিমাণ অনুসারে ভবনগুলো কালার কোড করে তালিকা প্রকাশ করা উচিত। এতে সচেতনতা বাড়বে এবং রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে ভবনগুলো মেরামতের পথ খুলবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে শক্তিশালী করা গেলে সেগুলোর স্থায়িত্ব ৫০ বছর বা তার বেশি বাড়ানো সম্ভব। তবে ঢাকার অনেক ভবন দ্রুত ঝুঁকি মূল্যায়নের প্রয়োজন। অধ্যাপক আনসারীর মতে, সরকার শুধু ঘোষণা দিলেই ভবন মালিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রেট্রোফিটিং করতে বাধ্য হবেন।
তারা আরও জানান, শুক্রবারের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় যে ক্ষতি দেখা গেছে, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে তার মাত্রা বহুগুণ বাড়বে। এতে দুই–তিন লাখ মানুষ হতাহত হতে পারে, ভেঙে পড়তে পারে শহরের ৩৫ শতাংশ ভবন।
তবে ব্যক্তিপর্যায়ের ভবন মালিকদের পক্ষে রেট্রোফিটিং ব্যয় বহন করা কঠিন। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার ও বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভবনগুলো রেট্রোফিটিং করাই তুলনামূলকভাবে বাস্তবসম্মত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. হুমায়ূন আখতার বলেন, “ভিত্তি দুর্বল জানলে সবাই ভবন ভেঙে ফেলতে পারবে না। তাই সচেতনতা বৃদ্ধিই এখন সবচেয়ে জরুরি। স্মার্টফোনভিত্তিক গেম বা ইন্টারেকটিভ উপায়ে জনসচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপুলসংখ্যক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন একসঙ্গে ভেঙে ফেলা বাস্তবসম্মত নয়। বরং যেগুলো রেট্রোফিটিংয়ে নিরাপদ করা যাবে না, সেগুলো ভাঙার ক্ষেত্রে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
পাঠকের মন্তব্য