![]()
দীর্ঘ এক দশকের গৃহযুদ্ধ, ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক সংকটের পর মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ে প্রবেশ করল।
ইসলামিক স্টেট (আইএস) গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গঠিত আন্তর্জাতিক জোটে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি।
ঘটনাটি শুধু সামরিক বা রাজনৈতিক নয়—এটি এক ঐতিহাসিক কূটনৈতিক মোড়, যা বহু বছরের বৈরিতার পর ওয়াশিংটন–দামেস্ক সম্পর্কের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
ওয়াশিংটনে ঐতিহাসিক বৈঠক: ট্রাম্প ও শারার প্রথম মুখোমুখি
সোমবার (১০ নভেম্বর) ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সিরিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার মধ্যকার প্রথম দ্বিপাক্ষিক বৈঠক।
১৯৪৬ সালে স্বাধীনতার পর এটাই প্রথমবার কোনো সিরীয় প্রেসিডেন্টের হোয়াইট হাউস সফর।
এক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, বৈঠকের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সিরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে আইএসবিরোধী বৈশ্বিক জোটে যোগদানের ঘোষণা দেয়। এর ফলে সিরিয়া হবে জোটের ৯০তম সদস্য দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের এক জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন—
“সন্ত্রাস দমন, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার সঙ্গে নতুনভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে।”
গৃহযুদ্ধের পর নতুন নেতৃত্ব: শারার পরিবর্তনের অঙ্গীকার
মাত্র এক বছর আগে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক নেতা আহমেদ আল-শারা বাশার আল-আসাদের দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসেন।
তাঁর নেতৃত্বাধীন সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) একসময় আল–কায়েদার সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিল,
তবে সাম্প্রতিক সংস্কার নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র শারার নাম সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শারা সিরিয়াকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুনঃস্থাপন ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্য গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন।
হোয়াইট হাউস সফর সেই অঙ্গীকারের প্রতীকী বাস্তবায়ন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ট্রাম্পের প্রশংসা: “তিনি এক শক্তিশালী নেতা”
বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন—
“তিনি (শারা) অত্যন্ত শক্তিশালী এক নেতা। সংগ্রামী এক দেশ থেকে উঠে এসেছেন তিনি, এবং নিজেও সংগ্রামী মানুষ।”
ট্রাম্প আরও যোগ করেন—
“মানুষ বলে, তাঁর অতীতটা কঠিন ছিল। কিন্তু আমি বলব— যদি কারও অতীত কঠিন না হয়, তবে তাঁর ভবিষ্যৎও উজ্জ্বল হয় না।”
ট্রাম্পের এমন মন্তব্যকে অনেকে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার প্রতি আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংকেত হিসেবে দেখছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি পরিকল্পনায় সিরিয়া হবে “কেন্দ্রীয় উপাদান”
ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁর বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনায় সিরিয়াকে রাখা হয়েছে “মূল অংশীদার” হিসেবে।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, সিরিয়ার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হলে ইসরায়েল–হামাস সংঘাতসহ আঞ্চলিক অস্থিরতা অনেকাংশে কমে যাবে।
তবে এখনো স্পষ্ট নয়, সিরিয়া তার দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ইসরায়েল–এর সঙ্গে কোনো চুক্তি বা সমঝোতায় যাবে কি না।
এ বিষয়ে ট্রাম্প বলেছেন—
“সময়ই বলে দেবে; কিন্তু শান্তির পথে হাঁটতে হলে সবাইকে কিছুটা ছাড় দিতে হবে।”
শারার বক্তব্য: “আমরা চাই স্থিতিশীল, নিরাপদ ও মানবিক সিরিয়া”
বৈঠক শেষে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা বলেন—
“আমরা আমাদের অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি। আজ আমাদের লক্ষ্য হলো এমন একটি সিরিয়া গঠন করা, যেখানে নাগরিকরা নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে।”
গোলান মালভূমি নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে বিরোধ সম্পর্কে তিনি বলেন,
“এটি আমাদের জন্য জটিল বিষয়। তবে আমরা বিশ্বাস করি, ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতা আলোচনার দরজা খুলে দিতে পারে।”
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট কার্যালয় থেকে এক্স (পূর্বে টুইটার)-এ দেওয়া এক পোস্টে জানানো হয়,
শারা ও ট্রাম্প দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক দৃঢ় করা ও আঞ্চলিক স্বার্থে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
নতুন আশা: যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে সম্ভাবনার পথে
সিরিয়া দীর্ঘ এক দশকের গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাস ও মানবিক বিপর্যয়ের পর অবশেষে পুনর্গঠনের পথে হাঁটছে।
এই যাত্রা সহজ নয়, কিন্তু এই ঘোষণার মাধ্যমে সিরিয়া আন্তর্জাতিকভাবে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়ার এই পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যের সূচনা করতে পারে।
পাঠকের মন্তব্য