কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম পিয়ারাতলী— একসময় যেখানে প্রযুক্তি মানেই ছিল দূরের কিছু, এখন সেই গ্রামেই তৈরি হচ্ছে মোবাইল ফোন, যা যাচ্ছে দেশের বাইরে। গ্রামের অর্ধশিক্ষিত নারীরা এখন দক্ষ কারিগর। তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে তারা হয়ে উঠেছেন প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তা ও শ্রমশক্তি।
স্থানীয় প্রতিষ্ঠান হালিমা টেলিকমে কাজ করছেন প্রায় ২০০ নারী। ছোট্ট কারখানাটি এখন পিয়ারাতলীর গর্ব, যা বদলে দিয়েছে গ্রামের অর্থনীতি ও নারীর জীবনযাত্রা।
হোটেল বয় থেকে উদ্যোক্তা
এই উদ্যোগের নেপথ্যে আছেন উদ্যোক্তা আবুল কালাম হাসান টগর। একসময় তিনি কাজ করতেন হোটেলে। অল্প পুঁজি নিয়ে ঢাকায় গিয়ে শুরু করেন মোবাইল রিচার্জ কার্ড বিক্রি। ধীরে ধীরে ব্যবসার অভিজ্ঞতা অর্জন করে তিনি ফিরে আসেন কুমিল্লায় এবং গ্রামীণফোনের ডিলার হন।
২০১০ সালে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘হালিমা টেলিকম’। একই বছর চীন সফরে গিয়ে মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করে দেশে ফিরে শুরু করেন হাতে বানানো বাটন মোবাইল তৈরির কাজ। শুরুতে ক্ষতি হলেও থেমে যাননি তিনি। প্রযুক্তি শেখেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, আর আজ সেই উদ্যোগই হয়ে উঠেছে একটি সফল কারখানা।
নারীর হাতে মোবাইল তৈরি
বৃহস্পতিবার বিকেলে পিয়ারাতলীর কারখানায় গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন এক চিত্র। কেউ এলসিডি বসাচ্ছেন, কেউ কী-প্যাড লাগাচ্ছেন, কেউ বা ব্যাক কভার ঠিক করছেন। প্রায় ৩০টি ধাপ শেষে তৈরি হচ্ছে একটি সম্পূর্ণ মোবাইল হ্যান্ডসেট। পরে তা পাঠানো হয় সংরক্ষণ ও রপ্তানির জন্য।
কারখানার কর্মী শিউলি আক্তার বলেন,
“প্রথমে কিছুই জানতাম না। তিন মাসের প্রশিক্ষণে এখন পুরো মোবাইল বানাতে পারি। অনেক সময় বাড়িতেও কাজ করি। গ্রামের অনেক নারী এখন এই কাজ জানে।”
আরেক কর্মী ফারজানা বলেন,
“আগে ভাবতাম এই কাজ শুধু শহরের মেয়েরাই পারে। এখন আমরাও পারি, নিজের আয়ে সংসার চালাতে পারি।”
পরিবর্তনের গল্প
হালিমা টেলিকমের সেলস অ্যাডমিন ওমর হাসান বলেন,
“আগে এসব নারীরা কোনো কাজ জানতেন না। এখন নিজেরাই মোবাইল ফোন তৈরি করছেন, সংসারের আয় রোজগারে ভূমিকা রাখছেন। আমাদের চেয়ারম্যানের স্বপ্ন ছিল— গ্রামীণ নারীদের প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করা।”
হালিমা হাইটেক পার্কের প্রোডাকশন হেড মিজানুর রহমান জানান,
“চীন থেকে যন্ত্রাংশ আনা হয়। ধাপে ধাপে জোড়া লাগানো, পরীক্ষা, তারপর প্যাকেটিং— সবই এখানেই হয়। এসব মোবাইল দেশের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।”
প্রযুক্তিতে নারীর জাগরণ
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবুল কালাম হাসান টগর বলেন,
“একসময় হোটেল বয়ের কাজ করতাম, এখন আমার পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১,৪০০ জন কাজ করেন, যার ৯৫ শতাংশই নারী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা এখন দক্ষ কর্মী। তারা সংসার চালাচ্ছেন, সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ছেন।”
এখন পিয়ারাতলী শুধু একটি গ্রাম নয়, এটি কুমিল্লার “মোবাইল তৈরির গ্রাম” নামে পরিচিত। এখানকার নারীরা প্রযুক্তির স্পর্শে বদলে দিয়েছেন নিজের জীবন, আর গোটা গ্রাম হয়ে উঠেছে উন্নয়নের অনুপ্রেরণা।
পাঠকের মন্তব্য