মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত আছে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে।
অক্টোবর মাস এলেই বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ ও মানবাধিকারকর্মীদের মনে জেগে ওঠে এক প্রশ্ন—“এবার নোবেল পাচ্ছেন কে?”
সোমবার থেকে শুরু হলো বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি নোবেল পুরস্কার ঘোষণার প্রক্রিয়া।
প্রথমেই ঘোষণা করা হয়েছে চিকিৎসাশাস্ত্রে বিজয়ীদের নাম, যা ঘোষণা করেছে স্টকহোমের কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট।
এরপর ধারাবাহিকভাবে মঙ্গলবার পদার্থবিদ্যা, বুধবার রসায়ন, বৃহস্পতিবার সাহিত্য এবং শুক্রবার শান্তিতে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে।
অর্থনীতিতে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে আগামী ১৩ অক্টোবর, আর ১০ ডিসেম্বর, আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে অনুষ্ঠিত হবে আনুষ্ঠানিক পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান।
আলফ্রেড নোবেলের মানবিক উত্তরাধিকার
নোবেল পুরস্কারের সূচনা এক ব্যতিক্রমী মানবিক চিন্তা থেকে।
সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল, যিনি ডিনামাইট আবিষ্কার করে বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছিলেন, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নিজের সম্পদের ভিন্ন পরিকল্পনা করেন।
তার উইলে তিনি লিখেছিলেন—এই সম্পদ ব্যবহার হবে মানবকল্যাণে অসাধারণ অবদান রাখা ব্যক্তিদের সম্মানিত করতে।
এই মহান উদ্যোগ থেকেই ১৯০১ সালে শুরু হয় নোবেল পুরস্কারের যাত্রা, যা আজও পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী ও মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত।
ছয়টি শাখায় শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি
নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় মোট ছয়টি শাখায়—
চিকিৎসা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতি।
তবে শুরুতে অর্থনীতি শাখা ছিল না।
১৯৬৮ সালে, আলফ্রেড নোবেলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ৩০০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার চালু করে।
কে দেয় কোন পুরস্কার
আলফ্রেড নোবেল নিজেই নির্ধারণ করেছিলেন কোন প্রতিষ্ঠান কোন শাখার পুরস্কার ঘোষণা করবে:
-
পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন: রয়েল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস
-
চিকিৎসা: সুইডেনের কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট
-
সাহিত্য: সুইডিশ অ্যাকাডেমি
-
শান্তি: নরওয়ের সংসদ (নোবেল কমিটি)
-
অর্থনীতি: সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস
নির্বাচন প্রক্রিয়ার গোপনীয়তা ও মর্যাদা
নোবেল পুরস্কারের নির্বাচন প্রক্রিয়া বিশ্বের সবচেয়ে গোপন ও নিরপেক্ষ প্রক্রিয়াগুলোর একটি।
মনোনয়ন জমা দিতে হয় ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে।
এরপর মার্চে শর্টলিস্ট, মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত উপদেষ্টাদের পর্যালোচনা, আর অক্টোবর মাসে ঘোষণা।
পুরো প্রক্রিয়া ৫০ বছর পর্যন্ত গোপন রাখা হয়—মনোনীতদের নামও জানা যায় না।
এ কারণে নোবেল পুরস্কার কেবল সম্মান নয়, এটি হয়ে ওঠে এক ঐতিহাসিক স্বীকৃতি।
পুরস্কারের পরিমাণ ও সম্মান
প্রতিটি বিভাগে বিজয়ী পান—
-
১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনর (প্রায় ১২ লাখ ডলার বা প্রায় ১৪ কোটি টাকা)
-
১৮ ক্যারেটের স্বর্ণপদক
-
একটি সম্মাননাপত্র।
প্রতিটি শাখায় সর্বোচ্চ তিনজনকে যৌথভাবে পুরস্কৃত করা যায়।
নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০২৫: রেকর্ড সংখ্যক মনোনয়ন
চলতি বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পড়েছে ৩৩৮টি,
যার মধ্যে ২৪৪ জন ব্যক্তি এবং ৯৪টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এমন বৈচিত্র্যময় তালিকা প্রমাণ করে—মানবকল্যাণের জন্য বিশ্বজুড়ে চলছে অবিরাম প্রচেষ্টা।
মানবতার শ্রেষ্ঠ সম্মান
নোবেল পুরস্কার কেবল অর্জনের স্বীকৃতি নয়; এটি মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতীক।
যেখানে আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছার মূল কথা ছিল—“মানুষের কল্যাণে কাজ করাই সর্বোচ্চ মহত্ত্ব।”
এক শতাব্দী পেরিয়ে আজও সেই মহত্ত্বের ধারা অব্যাহত রয়েছে, নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও শান্তিকর্মীদের অনুপ্রেরণা হয়ে।
পাঠকের মন্তব্য