দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমে মুখোমুখি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
লন্ডনে নির্বাসিত এই নেতার সঙ্গে বিবিসি বাংলার সম্পাদক মীর সাব্বির ও সিনিয়র সাংবাদিক কাদির কল্লোলের একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, নির্বাচন, সংস্কার, কূটনীতি ও গণতন্ত্রের নানা দিক।
বিবিসির সৌজন্যে দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের শেষ অংশে তারেক রহমান দেশের রাজনীতি, সংস্কার ও জনগণের ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক
সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান বলেন, “আমরা চাই অন্তর্বর্তী সরকার সফল হোক। তাদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে এমন কিছু সংস্কার করা, যেগুলো না করলে চলবে না। একই সঙ্গে একটি সুষ্ঠু, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। আমরা আশা করি, সরকার তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পন্ন করবে।”
তিনি উল্লেখ করেন, সরকারের কাজ কতটা স্বচ্ছ ও কার্যকর হচ্ছে তার ওপরই ভবিষ্যৎ সম্পর্কের উষ্ণতা বা শীতলতা নির্ভর করবে।
তারেক রহমান বলেন, “আমরা চাই সরকার সঠিকভাবে কাজ করুক, কারণ দেশের কল্যাণই আমাদের মূল লক্ষ্য।”
নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ ও ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক
অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে তারেক রহমানের পূর্বের মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যখন আমি বলেছিলাম, তখন পর্যন্ত সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ দেয়নি। সেই সময় প্রায় সবার মনেই সন্দেহ ছিল।”
তবে তিনি স্বীকার করেন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে রোডম্যাপ ঘোষণার পর সন্দেহ ধীরে ধীরে দূর হচ্ছে।
লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, “নির্বাচনের বাইরেও আমাদের সৌজন্যমূলক আলোচনা হয়েছে। তিনি জানতে চেয়েছিলেন—বিএনপি সুযোগ পেলে দেশের জন্য কী করবে। আমরা দেশের মানুষের কল্যাণ নিয়েই আলোচনা করেছি।”
অন্তর্বর্তী সরকারের মূল্যায়ন
তারেক রহমান বলেন, “বাংলাদেশ বিশাল একটি দেশ—২০ কোটি মানুষের দেশ। এটিকে পরিচালনা করতে হলে জনগণের ম্যান্ডেটসহ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদের সীমাবদ্ধতাও আছে।”
তিনি উল্লেখ করেন, “তারা যেভাবে চেষ্টা করছে, তাতে কিছু সফলতা এসেছে, কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। তবে তাদের সদিচ্ছা আছে বলেই মনে হয়।”
এক–এগারো প্রসঙ্গে
এক–এগারোর সময়ের সরকার সম্পর্কে তারেক রহমান বলেন,
“এক–এগারোর সরকার একটি অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সরকার ছিল। তারা সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছিল। দেশকে অন্ধকার দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিল।”
তিনি আরও বলেন, “পরবর্তীতে আমরা দেখেছি, তাদেরই অন্য রূপ ‘ইন দ্য নেম অব ডেমোক্রেসি’। গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে।”
বিএনপির দর্শন ও ভবিষ্যৎ ভাবনা
বিএনপির রাজনীতি নিয়ে তারেক রহমান বলেন,
“আমাদের রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণ, দেশ ও সার্বভৌমত্ব। আমরা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প ও প্রবাসী আয়ের সূচনা করেছি, যা আজ দেশের অর্থনীতির দুই স্তম্ভ।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “ভবিষ্যতে আমাদের লক্ষ্য—গণতন্ত্রের ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং বহুদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা।”
সংস্কার ও রাজনৈতিক মতভেদ
সংস্কার নিয়ে চলমান বিতর্কে তারেক রহমান বলেন,
“বাংলাদেশ রাষ্ট্র মেরামতের জন্য সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু এক ব্যক্তি তিন পদে থাকলে স্বৈরতন্ত্র আসবেই—এ ধারণা সঠিক নয়। এটি নির্ভর করে ব্যক্তির সততা ও গণতান্ত্রিক চেতনার ওপর।”
তিনি অভিযোগ করেন, “বিএনপি যদি দ্বিমত পোষণ করে, তখনই বলা হয় এটা বেঠিক। অথচ গণতন্ত্রের মূল সত্তাই হলো—মতভেদ থাকা।”
কূটনীতি ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক
তারেক রহমান বলেন, “বিএনপির মূলনীতি একটাই—সবার আগে বাংলাদেশ।
আমার জনগণ, আমার সার্বভৌমত্ব—এটাই সবার উপরে। আমি বাংলাদেশের স্বার্থকেই আগে রাখব।”
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে তিনি বলেন,
“আমরা আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা চাই। ফেলানীর মতো মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড যেন আর না ঘটে, সে দাবি জানাই।”
মিডিয়া, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ভবিষ্যৎ সরকার
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে প্রশ্নে তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন,
“বিএনপি ক্ষমতায় এলে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দমন–পীড়ন, গুম, ভয়ভীতি প্রদর্শন—এসব হবে না। অতীতেও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।”
তিনি যোগ করেন, “সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলোচনা করে কালো আইনগুলো ধীরে ধীরে বাতিল করা হবে।”
ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ: মানবিক ও পরিবেশ সচেতন তারেক রহমান
রাজনীতির বাইরে তারেক রহমানের মানবিক দিকও ফুটে ওঠে সাক্ষাৎকারে।
নিজের মেয়ের পোষা বিড়াল ও প্রাণীপ্রেম নিয়ে তিনি বলেন,
“প্রাণী ও প্রকৃতি ছাড়া মানুষ টিকতে পারবে না। প্রকৃতিকে বাঁচাতে হলে সবুজায়ন ও পশুপাখির সুরক্ষা জরুরি।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে সবুজের পরিমাণ এখন মাত্র ১২ শতাংশের মতো—এটা বিপজ্জনক। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই প্রকৃতি ও প্রাণীকূলকে রক্ষা করতে হবে।”
শেষ বক্তব্য: অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন দিগন্ত
সাক্ষাৎকারের শেষাংশে তারেক রহমান বলেন,
“আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, আমরা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি। জনগণের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও জনগণের অধিকার রক্ষাই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতির মূল ভিত্তি।”
পাঠকের মন্তব্য