১৯৮৮ সালে যখন বাজারে আসে ‘অনন্যা’ নামের অডিও ক্যাসেট, তখনই বাংলা সংগীত জগতে প্রবেশ করলেন এক তরুণ, যার গলায় ছিল বিদ্রোহের হাহাকার আর সুরে ছিল সীমাহীন স্বাধীনতার ডাক। আসিফ ইকবালের কথায় ক্যাসেটের ১১টি গানেই সুর ও কণ্ঠ দেন মাত্র ২৪ বছর বয়সী সেই তরুণ—ফারুক মাহফুজ আনাম, যিনি আজ সমগ্র বাংলার কাছে পরিচিত জেমস নামে।
তখন তার ব্যান্ডের নাম ছিল ফিলিংস। নওগাঁ থেকে পরিবার ছেড়ে চট্টগ্রাম, তারপর আজিজ বোর্ডিং—এই দীর্ঘ পথচলায় এক শান্ত, অন্তর্মুখী যুবক ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন উত্তাল সংগীত স্রোতের প্রতীক। ‘জেল থেকে বলছি’ অ্যালবামের টাইটেল গান কিংবা শিবলীর লেখা ‘পেশাদার খুনি’–র মতো গান বাংলা ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
সাইকেডেলিক রকের জনক
যেখানে আইয়ুব বাচ্চু, ফোয়াদ নাসের বাবু বা আশিকউজ্জামান টুলুর মতো সুরকাররা সংগীতের ঐতিহ্যবাহী প্যাটার্ন মেনে কাজ করছিলেন, সেখানে জেমস ভেঙে ফেললেন নিয়মের শেকল। তিনি নিয়ে এলেন বাংলায় সাইকেডেলিক রক। তার কণ্ঠ হয়ে উঠল আশাহত তরুণদের আত্মার প্রতিধ্বনি, বিদ্রোহ আর মুক্তির চিৎকার।
লিরিক্স ও দার্শনিক আবহ
জেমসের সঙ্গে যুক্ত হলেন কবিসুলভ গীতিকার আসাদুল্লাহ দেহলভী। দেহলভীর লিরিকে উঠে এলো গ্রামীণ জীবনের চরিত্র, হারানো প্রিয়জনের স্মৃতি, এমনকি প্রফেসির মতো ভবিষ্যদ্বাণীমূলক উচ্চারণ। জেমস সেই কবিতাগুলোকে গলায় ধারণ করে দাঁড়ালেন এক শিষ্যকে পথ দেখানো গুরুর মতো।
তার গান শুধু প্রেম বা বেদনার কথা বলে না, বরং তুলে ধরে ইতিহাস, সংগ্রাম আর প্রান্তিক মানুষের জীবনযুদ্ধ। ‘সেলাই দিদিমণি’, ‘বাংলার লাঠিয়াল’, কিংবা ‘চিরহরিৎ’–এর মতো গানগুলো আমাদের শোনায় শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষের অজানা গল্প।
মুক্ত সুরের আহ্বান
জেমস ছিলেন নিয়ম ভাঙার প্রতীক। গিটার হাতে তিনি যেকোনো সময় গান ধরতেন, ভেঙে দিতেন ধারাবাহিকতার বাঁধন। তার গান কখনো ধীর, কখনো উত্তাল—একেবারেই ফর্মুলার বাইরে। যেমন ‘হে পাগলি’ কিংবা ‘হাউজি’র মতো গানগুলোতে শ্রোতারা পেয়েছেন সেই অস্থিরতা, যে অস্থিরতা বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়।
দ্রোহ ও প্রেমের সমীকরণ
জেমসের গানে প্রেমও এসেছে বিদ্রোহের সঙ্গে মিশে। যেমন ‘থাকিস যদি পাশাপাশি’ গানটি কেবল প্রেম নয়, বরং পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রেমিকাকে আগলে রাখার শপথ। তার গানে প্রেম, দ্রোহ, আশা, হতাশা—সব একসঙ্গে প্রবাহিত হয়েছে।
প্রজন্মের প্রতিনিধি
এক প্রজন্মের হতাশা, বেদনা, অবহেলা—সব কিছুর মধ্যে আশার আলো হয়ে উঠেছিলেন জেমস। তিনি ছিলেন তরুণদের মুক্তির কণ্ঠ, যারা শৃঙ্খল ভাঙতে চেয়েছিল, যারা খুঁজছিল আকাশের মুক্তি।
আজ এই বাংলা রকের মুক্ত পাখি জেমসের ৬১তম জন্মদিনে সংগীতপ্রেমীরা স্মরণ করছে তার অমূল্য অবদান। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, খাঁচা ভাঙা পাখির জন্য পুরো আকাশটাই খোলা।
পাঠকের মন্তব্য