জাহিদুজ্জামান সাঈদ
ই-কমার্সের নতুন ইতিহাস সৃষ্টির পথে ইন্দোনেশিয়া
বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল ই-কমার্স বাজার এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপদেশ ইন্দোনেশিয়া। ২৭০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের দেশটি প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট প্রবৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে যে গতিতে ডিজিটাল অর্থনীতিতে জায়গা করে নিচ্ছে, তা একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে উদীয়মান উদ্যোক্তাদের জন্যও সৃষ্টি করছে এক সুবর্ণ সুযোগ।
McKinsey-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় ৪৪ মিলিয়ন অনলাইন ক্রেতা তৈরি হবে এবং বাজারের আকার পৌঁছাবে ৫৫ থেকে ৬৫ বিলিয়ন ডলারে। Google ও Temasek-এর আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে দাঁড়াবে ৫৩ বিলিয়ন ডলারে।
কীভাবে সম্ভব হলো ইন্দোনেশিয়ার ই-কমার্স বিপ্লব?
ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলোর একটি। কিন্তু কয়েক বছর আগেও অনলাইন বাণিজ্যে দেশটির অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। আজকের চিত্র একেবারে ভিন্ন—দেশটি দ্রুত গতিতে ই-কমার্স খাতে বিশ্বমঞ্চে নিজের অবস্থান শক্ত করছে। কীভাবে এই পরিবর্তন সম্ভব হলো?
সহজ প্রবেশপথ ও স্কেলেবিলিটি
আগে ব্যবসা শুরু মানেই ছিল পুঁজি, দোকানভাড়া, কর্মচারী, মালামাল এবং বিপণনের জটিল সমন্বয়। কিন্তু ই-কমার্স সেই বাধাগুলো দূর করেছে।
বর্তমানে উদ্যোক্তারা মোবাইল ফোন অথবা ল্যাপটপ ব্যবহার করে সহজেই একটি অনলাইন দোকান খুলতে পারছে। পণ্য তালিকাভুক্তি, ডিজিটাল মার্কেটিং, পেমেন্ট গেটওয়ে, এমনকি ডেলিভারি সার্ভিস—সবই এখন ডিজিটালভাবে সহজলভ্য। ফলে যারা আগে ব্যবসা করার কথা ভাবেননি, তারাও এখন উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন।
সরকারি নীতির উদারতা
ই-কমার্স খাতে সরকারের ইতিবাচক অবস্থান এই খাতের বিস্তারে বড় ভূমিকা রেখেছে। যেমন, ২০১৮ সালে ই-কমার্স লেনদেনে কর আরোপের একটি প্রস্তাবিত আইন—PMK 210/2018—সরকার বাতিল করে দেয় উদ্যোক্তাদের চাপে। এর ফলে অনলাইন উদ্যোক্তারা নতুন উদ্দীপনা নিয়ে ব্যবসায় নেমেছেন।
এই ধরনের নীতিগত সহায়তা ই-কমার্স খাতকে ঝুঁকিমুক্ত ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
গ্রামীণ এলাকায় মূল্য সাশ্রয় ও সুযোগের বিস্তার
ই-কমার্স শহরকেন্দ্রিক একটি ধারণা হলেও, ইন্দোনেশিয়ায় তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামীণ এলাকায়।
McKinsey-এর একটি গবেষণায় দেখা যায়, জাভা দ্বীপের বাইরের গ্রাহকরা ১১% থেকে ২৫% পর্যন্ত খরচ সাশ্রয় করতে পারছে অনলাইন কেনাকাটার মাধ্যমে। কারণ, অনলাইন পণ্যের দাম কম, ডিসকাউন্ট বেশি, আর পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে সরাসরি দরজায়।
এতে করে গ্রামীণ ভোক্তারা যেমন উপকৃত হচ্ছে, তেমনি স্থানীয় উদ্যোক্তারাও পাচ্ছেন বড় বাজারের সুবিধা।
নারীর ক্ষমতায়ন ও আর্থ-সামাজিক প্রভাব
ই-কমার্স ইন্দোনেশিয়ার সমাজে একটি নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে—নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে।
অনেক নারী এখন ঘরে বসেই অনলাইন ব্যবসা পরিচালনা করছেন। গৃহস্থালীর দায়িত্ব সামলে তারা আয় করছেন নিজের এবং পরিবারের জন্য। এ ধরনের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়িয়েছে, পরিবারে ও সমাজে তাদের অবস্থান আরও মজবুত হয়েছে।
বাংলাদেশ কী শিখতে পারে?
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১২ কোটিরও বেশি, তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বিশাল, এবং উদ্যোক্তা হবার প্রতি আগ্রহ দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু ই-কমার্স খাতের প্রকৃত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে কিছু কাঠামোগত, নীতিগত ও প্রযুক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
১. ট্যাক্স ও লাইসেন্স পলিসি সহজীকরণ
সমস্যা: বর্তমানে অনলাইন ব্যবসা করতে হলে একাধিক লাইসেন্স, ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, BIN ইত্যাদি নিতে হয়, যা অনেকের পক্ষেই জটিল ও ব্যয়বহুল।
সমাধান:
ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য এক-ক্লিক লাইসেন্সিং সিস্টেম চালু করা উচিত।
প্রাথমিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের জন্য মাইক্রো বিজনেস ট্যাক্স ছাড় দেওয়া যেতে পারে।
একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ট্যাক্স হলিডে বা ইনকিউবেশন পিরিয়ড নির্ধারণ করলে স্টার্টআপ গুলোর গ্রোথ নিশ্চিত হবে।
ইন্দোনেশিয়া PMK 210/2018 ট্যাক্স আইন বাতিল করে যা ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছিল। বাংলাদেশেরও এমন উদারতা দরকার।
২. লজিস্টিকস অবকাঠামো উন্নয়ন
সমস্যা: পণ্যের সময়মতো ডেলিভারি এখনো বড় চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে শহরের বাইরে।
সমাধান:
জেলা ও উপজেলা ভিত্তিক মাইক্রো ফুলফিলমেন্ট হাব বা পিকআপ পয়েন্ট স্থাপন করতে হবে।
স্থানীয় কুরিয়ার/ইজারা গাড়িচালিত লজিস্টিক চেইন তৈরি করলে খরচ কমবে ও কর্মসংস্থান বাড়বে।
ডিজিটাল ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু করে পণ্য পরিবহনে স্বচ্ছতা ও গ্রাহকের আস্থা অর্জন করা যাবে।
Shopee ও Tokopedia-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলি স্থানীয় দোকান বা কুরিয়ার এজেন্টদের যুক্ত করে লাস্ট মাইল ডেলিভারি নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশেও এই মডেল কার্যকর হবে।
৩. নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা
সমস্যা: নারী উদ্যোক্তারা সামাজিক সীমাবদ্ধতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতির কারণে পিছিয়ে আছেন।
সমাধান:
ই-কমার্স ট্রেনিং প্রোগ্রাম শুধু নারীদের জন্য চালু করতে হবে (গ্রামীণ ও প্রান্তিক এলাকায় বিশেষভাবে)।
অভিজ্ঞ নারী উদ্যোক্তাদের মেন্টরশিপ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে।
ইকুইটি-মুক্ত, স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা দিতে হবে নারী নেতৃত্বাধীন স্টার্টআপদের।
ইন্দোনেশিয়ার Tokopedia এবং Facebook Indonesia নারীদের জন্য বিশেষ ই-কমার্স কোর্স চালু করেছে। একই কাজ আমাদেরও করতে হবে।
৪. ডিজিটাল পেমেন্ট ও ক্যাশলেস ট্রানজেকশনে উৎসাহ
সমস্যা: এখনও গ্রাহকরা ক্যাশ অন ডেলিভারিকে বেশি পছন্দ করেন, যা ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল।
সমাধান:
মোবাইল ওয়ালেট (বিকাশ, নগদ, রকেট)-এর চার্জ কমিয়ে ই-কমার্স ট্রানজেকশনকে উৎসাহিত করতে হবে।
ই-কমার্স সাইটে ইনট্যুইটিভ ও ট্রাস্টেড পেমেন্ট গেটওয়ে ইন্টিগ্রেশন করতে হবে।
ডিজিটাল ইনসেনটিভ (ক্যাশব্যাক, ডিসকাউন্ট) চালু করলে ব্যবহারকারীরা ধীরে ধীরে ক্যাশলেস অভ্যস্ত হবেন।
ইন্দোনেশিয়ায় GoPay, OVO-এর মতো ডিজিটাল পেমেন্ট অ্যাপগুলোর মাধ্যমে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশেও এটিই ভবিষ্যত।
৫. আঞ্চলিক ই-কমার্স সমতা আনা
সমস্যা: অধিকাংশ উদ্যোক্তা, ই-কমার্স ট্রেনিং, লজিস্টিক সুবিধা ও টেকনিক্যাল সাপোর্ট শুধুমাত্র ঢাকা-কেন্দ্রিক।
সমাধান:
জাতীয় ই-কমার্স ইনকিউবেশন হাব জেলা পর্যায়ে চালু করতে হবে।
ই-কমার্স অ্যাক্সিলারেটর প্রোগ্রাম চালু করে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ইত্যাদি অঞ্চলের স্টার্টআপদের জন্য বিশেষ সুযোগ তৈরি করতে হবে।
ই-কমার্স ভিলেজ বা ইউনিয়ন পর্যায়ে ফিল্ড সাপোর্ট টিম গঠন করা যেতে পারে, যেটি e-Farmers বা Digital Polli-এর মতো মডেল ব্যবহার করে করা সম্ভব।
ইন্দোনেশিয়ায় গ্রাম পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের জন্য Tokopedia Partners নামে একটি প্রোগ্রাম চালু হয়েছে, যেখানে স্থানীয় দোকানরাই অনলাইন হাবে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত এখন এক ‘প্রাক-বিস্ফোরণ’ পর্যায়ে অবস্থান করছে। ঠিক যেমন ইন্দোনেশিয়া একসময় ছিল। এখনই সঠিক নীতিগত ও কাঠামোগত পদক্ষেপ নিলে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত হতে পারে:
১০ বিলিয়ন ডলারের বাজার
১০ লাখ নতুন উদ্যোক্তা
নারী নেতৃত্বে নতুন ডিজিটাল অর্থনীতি
বাংলাদেশ চাইলে ই-কমার্সে শুধু ব্যবসায় নয়, সমতা, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যমেও নেতৃত্ব দিতে পারে। শুধু প্রয়োজন একটু সহায়তা, একটু দূরদর্শিতা।
ইন্দোনেশিয়া প্রমাণ করেছে, একটি উন্নয়নশীল দেশও যদি সঠিক নীতিমালা, প্রযুক্তি ও উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে— তাহলে বিশ্ববাজারে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশের সময় এখনই — ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে শুরু করে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার।ই-কমার্স শুধু অনলাইন কেনাবেচা নয়, এটি হতে পারে বাংলাদেশের নতুন বৈপ্লবিক অর্থনীতি।”
লিখেছেনঃ
জাহিদুজ্জামান সাঈদ
এডিটর -ইন-চিফ
এন্টারপ্রেনিয়র বাংলাদেশ
[লেখক, গবেষক ও রুরাল ডেভেলপমেন্ট এক্সপার্ট ]