![]()
ঢাকার ব্যস্ততম মহাখালী এলাকার কড়াইল বস্তি—যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষের জীবন চলে কঠোর পরিশ্রম আর ক্ষুদ্র আয়ের নির্ভরতায়। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৫টা ২২ মিনিটে হঠাৎ জেগে ওঠা আগুনে মুহূর্তেই পাল্টে যায় তাদের জীবনের চিত্র। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়া আগুনে পুড়ে গেছে দেড় হাজারেরও বেশি ঘর। প্রাণহানি না ঘটলেও হাজারো মানুষের আশ্রয়, জমানো স্বপ্ন, ছোট্ট সুখ—সবই পুড়ে ছাই হয়ে যায় কয়েক ঘণ্টায়।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, দীর্ঘ যানজট ও বস্তির সরু গলির কারণে প্রথমে ইউনিটগুলো ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দেরি হয়। পরে একে একে ১৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেয়। পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আগুনের সাথে লড়াই করে রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার ঘোষণা দেয় ফায়ার সার্ভিস। পুরোপুরি নির্বাপণে সময় লেগেছে বুধবর সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত।
খোলা আকাশের নিচে দীর্ঘ রাত
আগুনের উত্তাপ থেমে গেলেও বস্তির মানুষের চোখের উত্তাপ কমেনি। শিশু, নারী, বৃদ্ধ—সবাই খোলা মাঠে রাত কাটাতে বাধ্য হন। কেউ হারিয়েছেন প্রয়োজনীয় নথি, কেউ বই-খাতা, কারও বিছানা, আবার কারও রান্নার হাঁড়ি-পাতিল। আগুনে সব হারানো শ্রমিক মো. সেলিম পোড়া টিন তুলে ছোট একটি ঘর তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন সকালেই। স্ত্রী সুমি বলছিলেন,
“এক কাপড়ে জীবন বাঁচাইতে পারছি, আর কিছু না। বাচ্চা দুইডারে খাইতে বসাইছিলাম, তার মধ্যে আগুন। সব পুইড়া শ্যাষ।”
মানুষের আর্তনাদ—‘খাবারের চাইতে দরকার একটা ছাদ’
ভয়াবহ আগুনের পর বুধবার সকাল থেকেই দেখা যায়, মানুষজন পোড়া ঘরের ভেতর ঘুরে ঘুরে খুঁজছেন অক্ষত কিছু আছে কিনা। অনেকের চোখে অশ্রু, কারও মুখে নির্বাক শোক।
সাহেরা খাতুনের কণ্ঠে আতঙ্ক এখনো স্পষ্ট—
“এক কাপড়ে বাসা দিয়া বাইর হইছি। জীবনডাই বাঁচাইতে পারছি, আর কিছু না। খাবার লাগবে ঠিক, কিন্তু আমার এখন প্রথম দরকার মাথার ওপর ছাদ।”
বস্তির বাসিন্দাদের বেশিরভাগই রিকশাচালক, নির্মাণ শ্রমিক, হকার বা পোশাককর্মী। তাদের সীমিত আয়েই চলে সংসার। যে ঘরে তারা আশ্রয় নিতেন, সেই ঘরটাই আজ ধংসস্তূপ।
আগুন ছড়ানোর সবচেয়ে বড় কারণ—গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ
স্থানীয় বাসিন্দা লুৎফা বেগম জানালেন, আগুনের শুরুতেই তিনি একটি বড় শব্দ শুনেছিলেন।
“দেখি পাশের বাসায় সিলিন্ডার বাস্ট। তারপরেই আগুন দাউ দাউ কইরা ছড়াইয়া যায়।”
বস্তির প্রতিটি ঘর মূলত টিন- বাঁশ- কাঠ দিয়ে তৈরি। গ্যাস লাইনের সুযোগ কম থাকায় বেশিরভাগ ঘরেই রান্না হয় এলপিজি সিলিন্ডারে। আগুন লেগেই একের পর এক সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হতে থাকে, যার ফলে আগুন মুহূর্তেই বড় আকার ধারণ করে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন,
“বস্তিতে গ্যাস সিলিন্ডারের সংখ্যা অনেক বেশি, সেগুলোই আগুন ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ হতে পারে।”
স্বেচ্ছাসেবক, সাংবাদিক ও মানুষের ভিড়ে বস্তি এলাকায় বিশৃঙ্খলা
বুধবার সকাল থেকে কড়াইল এলাকায় প্রবেশ করতেই দেখা যায় মানুষের ঢল। স্থানীয়রা, সাংবাদিক, ব্লগার, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন—সবাই আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা দেখতে ভিড় করছেন। খাবার বিতরণের চেষ্টাও চোখে পড়েছে, তবে অনেকে বলছেন—
“খাবারও লাগবে, কিন্তু এখন আশ্রয়টাই বড় সমস্যা।”
একদিকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর চেষ্টা, অন্যদিকে রাতের অন্ধকারে ফিরে পাওয়ার আশায় পোড়া ঘরে মানুষের ছোটাছুটি—পুরো এলাকা যেন এক গভীর মানবিক সংকটের প্রতিচ্ছবি।
নতুন করে ঘর গড়ার সংগ্রাম শুরু
সকালে আগুন নেভার পর অনেকেই পুড়ে যাওয়া টিন, বাঁশ কিংবা কাঠের টুকরো জড়ো করে নতুন করে একটি ছোট ঘর তৈরি করার চেষ্টা করছেন। সুমন হোসেন নামে এক বাসিন্দা নিজের ঘরের পুড়ে যাওয়া মেঝেতে পানি ঢালতে ঢালতে বলছিলেন—
“আগুন নিভলেও ফ্লোর খুব গরম। আগে ঠাণ্ডা করি, তারপর মাথার ওপর একটু ছাদ বানাই। ঢাকা শহরে তো আমাদের আর থাকার জায়গা নাই।”
কড়াইলের ইতিহাসে আগুন নতুন কিছু নয়। তবে এবার ক্ষতির পরিমাণ এত বেশি যে হাজারো মানুষের সামনে বেঁচে থাকার নতুন লড়াই শুরু হলো।
পাঠকের মন্তব্য