![]()
মানবতাবিরোধী অপরাধের এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। বহু আলোচিত ও বহু বিতর্কের জন্ম দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে নিয়ে গঠিত মামলার রায় আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পড়া শুরু হয়েছে।
সোমবার সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকার আদালতপাড়া যেন বদলে যায় নিরাপত্তার বেষ্টনীতে ঘেরা এক কঠোর সতর্ক অঞ্চলে—যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নিঃশ্বাসে ঝুলে রয়েছে দীর্ঘ এক মানবাধিকার বিচারযাত্রার ভার।
কড়া নিরাপত্তায় রায়পাঠ – রাষ্ট্রের শ্বাসরুদ্ধ প্রতীক্ষা
রায় ঘোষণার আগের রাত থেকেই ট্রাইব্যুনাল এলাকা ও সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বাড়ানো হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন, বিজিবি থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী—সব বাহিনীই অবস্থান নেয় বহুস্তরের নিরাপত্তা বলয়ে।
এ ছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের তৎপরতা ছিল নজরকাড়া।
জনসাধারণের চলাচল সীমিত করা হয়, দোয়েল চত্বর হয়ে শিক্ষাভবনমুখী সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে—সব মিলিয়ে পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে অস্বাভাবিক নীরবতা ও উত্তেজনা।
এ নীরবতার ভেতরেই রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে প্রিজনভ্যানে করে সকালে হাজির করা হয় ট্রাইব্যুনালে।
আইন, মানবাধিকার ও বিচার—এক দীর্ঘ পথচলার ফসল
মামলাটি শুধু একটি রাজনৈতিক অধ্যায়ের নয়—এটি বেদনাদীর্ণ মানুষ, শোকের ছাপ বহন করা পরিবার, এবং ন্যায়বিচারের আশায় দীর্ঘ প্রতীক্ষার গল্প।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আনা অভিযোগগুলো অত্যন্ত গুরুতর—
-
উসকানি
-
মারণাস্ত্র ব্যবহার
-
আবু সাঈদ হত্যা
-
চানখাঁরপুলে হত্যা
-
ও আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানো
এই পাঁচটি প্রধান অভিযোগই ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে বিস্তারিত প্রমাণসহ উপস্থাপন করা হয়।
সাক্ষী করা হয় ৮৪ জনকে, জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি ছিল ৪ হাজার ৫ পৃষ্ঠারও বেশি।
মোট ২৮ কার্যদিবসে সাক্ষ্য-জেরা এবং ৯ কার্যদিনে যুক্তিতর্ক ও পাল্টা যুক্তিখণ্ডন শেষে বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল–১ আজ রায় ঘোষণা শুরু করেন।
পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত অবস্থান
এই মামলায় পলাতক হিসেবে চিহ্নিত রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
তাদের অনুপস্থিতিতেই চলেছে বিচার প্রক্রিয়া—যা মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনেও অনুমোদিত পদ্ধতি।
রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্কে দাবি করে, মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রযোজ্য হওয়া উচিত, কারণ এই অপরাধ শুধু কোনো নির্দিষ্ট সময়কে নয়, বরং জাতির স্মৃতি, মানবতা ও ন্যায়ের ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
মানবিক ক্ষত—নিরাপত্তাহীনতা ও শোকের দীর্ঘ ছায়া
আবু সাঈদ হত্যা, চানখাঁরপুলে হত্যাকাণ্ড, লাশ পোড়ানো—এসব ঘটনা শুধু বিচারপঞ্জির নথি নয়, এগুলো পরিবার হারানো মানুষের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি।
এই মামলায় সাক্ষী দেওয়া অনেক ব্যক্তি এখনও মানসিক আঘাত থেকে বের হতে পারেননি।
অনেকে বলেছেন—
“রায়ের পর যদি ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে হয়তো আমাদের সন্তানদের আর এভাবে কাঁদতে হবে না।”
হিউম্যানিটারিয়ান দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিচার শুধু আইনের প্রয়োগ নয়—এটি মানুষের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের এক প্রচেষ্টা।
রাষ্ট্র, নাগরিক ও ন্যায়ের অঙ্গীকার
বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত, কারণ ক্ষমতায় থাকা কিংবা ক্ষমতা হারানো—কোনো অবস্থানই মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে দায়মুক্তির সুযোগ দেয় না।
ট্রাইব্যুনালের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের বিচার এবং মানবাধিকারের পথচলায় একটি নজির সৃষ্টি করবে।
শেষ প্রতীক্ষা—আজকের রায় নির্ধারণ করবে ইতিহাসের নতুন অধ্যায়
রাষ্ট্রপক্ষ, আইনজীবী, ভুক্তভোগীরা—সবাই আজ এক উত্তাল প্রতীক্ষায়।
এই রায় শুধু তিনজন আসামির ভাগ্য পরিবর্তন করবে না—এটি বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা, মানবতার প্রতি রাষ্ট্রের অবস্থান ও ইতিহাসের প্রতি দায়িত্বকে আরও স্পষ্ট করবে।
পাঠকের মন্তব্য