![]()
ভারতের পূর্বাঞ্চলের দরিদ্রতম ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর একটি বিহারের আলিনগর। বহু বছর ধরে এখানে উন্নয়নের আশায় মানুষ ভোট দিয়ে গেছে, কিন্তু প্রত্যাশা ও বাস্তবতার দূরত্ব কমেনি। এই প্রেক্ষাপটেই এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত নাম উঠে এসেছে—মাত্র ২৫ বছরের তরুণী মৈথিলী ঠাকুর। শাস্ত্রীয় সংগীতের মঞ্চে দীর্ঘদিন সক্রিয় থাকা এই শিল্পী এবার বিহারের রাজনৈতিক মঞ্চেও ইতিহাস তৈরি করেছেন।
বিজেপির প্রার্থী হিসেবে আলিনগর বিধানসভা আসনে লড়াই করে তিনি প্রায় ১১ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি)-এর প্রবীণ প্রার্থী বিনোদ মিশ্রকে। এবং এ বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি হয়ে গেলেন বিহারের সর্বকনিষ্ঠ বিধায়ক।
আলিনগরের মানুষের ভরসা—“এবার হয়তো বদল আসবে”
আলিনগরের মানুষের মুখে এখনো বিস্ময়—
“যে মেয়েটিকে আমরা ইউটিউবে গান গাইতে দেখতাম, আজ সে আমাদের বিধায়ক!”
বহু বছর ধরে এখানকার মানুষ দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শিক্ষার ঘাটতি ও অবকাঠামোর অভাবে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অবস্থা আরও করুণ। মৈথিলীর জয়ে তাই মানুষের আশা—
“যে মেয়ে এত সুন্দর করে গান দিয়ে মন ছুঁয়েছে, সে হয়তো এবার সত্যিকারের উন্নয়ন দিয়ে আমাদের জীবনও ছুঁতে পারবে।”
একজন বিধায়ক হিসেবে তার প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট—
তিনি নিজেকে বলেন “আলিনগরের ঘরের মেয়ে”, এবং ভোটের পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বলেন,
“এটি আমার কাছে স্বপ্নের মতো। আমার পুরো মনোযোগ থাকবে আলিনগরের উন্নয়নে।”
একটি মেয়ের বেড়ে ওঠা—সংগীতের আঙিনা থেকে সামাজিক দায়িত্বে
২০০০ সালের ২৫ জুলাই জন্ম নেওয়া মেয়েটি মধুবনীর সাধারণ এক পরিবারে বড় হয়েছেন। বাবা ও দাদার কাছ থেকেই পেয়েছেন শাস্ত্রীয় ও লোকসংগীতের কঠোর প্রশিক্ষণ।
সংগীতের দীর্ঘ সাধনার ফল মিলেছিল ২০১৭ সালে—
টিভি রিয়েলিটি শো ‘রাইজিং স্টার’–এ রানারআপ হয়ে তিনি দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন।
পরবর্তী সময়ে সামাজিক মাধ্যম হয়ে ওঠে তার সবচেয়ে বড় জায়গা। সেখানে তার পরিবেশিত শাস্ত্রীয় গান, মৈথিলী ভাষার লোকসংগীত এবং সহজ-সাবলীল উপস্থাপনা তাকে কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান দেয়।
এই জনপ্রিয়তাই তাকে সরাসরি পৌঁছে দেয় আলিনগরের মানুষের ঘরে ঘরে—
তার গান যেমন হৃদয়ে পৌঁছাতো, এবার রাজনীতির বার্তাও মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়।
তরুণ নেতৃত্বের শক্তি—বিহারের জন্য নতুন বার্তা
বিহার ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও উন্নয়ন বৈষম্যের জন্য পরিচিত। তরুণদের বড় অংশ রাজনীতিতে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব দেখতে চান।
মৈথিলীর মতো একজন তরুণীর সামনে এগিয়ে আসা তাই পুরো রাজ্যবাসীর কাছে এক নতুন বার্তা—
“তরুণরাও পারে—ইচ্ছা থাকলে পরিবর্তন সম্ভব।”
তিনি বিজয়ের পর বলেছেন—
“আমি শিল্পী হিসেবে মানুষকে আনন্দ দিয়েছি, এবার তাদের উন্নয়ন দিয়ে পাশে থাকতে চাই।”
মৈথিলীর সম্পদ—তরুণ বয়সে শক্তিশালী অবস্থান
মৈথিলীর নির্বাচনী হলফনামায় দেখা যায়—
-
কয়েক কোটি রুপির ব্যাংক ব্যালেন্স,
-
প্রায় ৫০ লাখ রুপির অলংকার,
-
৩ কোটি রুপির একটি ফ্ল্যাট,
-
এবং প্রায় ৯০ লাখ রুপির জমির অর্ধেক মালিকানা।
অনেকেই বলছেন, আর্থিক স্বচ্ছলতা তার রাজনৈতিক যাত্রাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। রাজনৈতিক চাপমুক্ত হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবেন—এমন প্রত্যাশাও রয়েছে আলিনগরের জনগণের।
আলিনগরের দরিদ্র মানুষের আকুতিতে নতুন স্বপ্ন
আলিনগরের একটি চর অঞ্চলে দেখা মিলল বৃদ্ধা মেরীর মতো অসহায় মানুষের।
তিনি বলেন—
“বছরের পর বছর শুনেছি উন্নয়নের কথা। কিন্তু খাবারের চিন্তা নিয়ে দিন কাটে। হয়তো এই মেয়েটা সত্যি কিছু করবে।”
এক কিশোরী জানায়—
“আমাদের এলাকার মেয়ে বিধায়ক হলো—এটাই বড় গর্ব। মেয়েদের জন্য কিছু করবে, আমরা বিশ্বাস করি।”
এই আশাগুলোই মানবিকভাবে সবচেয়ে বড় বার্তা দেয়—
মৈথিলীর জয় শুধু রাজনৈতিক হার–জয়ের গল্প নয়,
বরং বহু বছর ধরে বঞ্চিত মানুষের স্বপ্ন টিকে থাকার গল্প।
শেষকথা: সংগীতের মতো রাজনীতিতেও সুর মিলুক মানুষের জীবনে
মৈথিলী ঠাকুরের এই উত্থান শুধু এক তরুণীর গল্প নয়—
এটি বিহারের, বিশেষ করে আলিনগরের অসহায় মানুষের গল্প।
যে মানুষগুলো বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছে,
যে মানুষগুলো বিশ্বাস করতে চায়—
“পরিবর্তন সম্ভব।”
এখন সময় প্রমাণ করার—
সংগীত দিয়ে হৃদয় জয় করা যে মেয়েটি,
সে কি রাজনীতি দিয়ে মানুষের জীবনও বদলে দিতে পারবে?
মানুষ অপেক্ষায়।
পাঠকের মন্তব্য