![]()
গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত ও পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে দায়ের মামলার রায় ঘোষণা হবে আগামী ১৭ নভেম্বর।
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ রায়ের এ তারিখ নির্ধারণ করে।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতে শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন।
তিনি বলেন,
“এই মামলা শুধু তিনজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, এটি ইতিহাস, ন্যায়বিচার ও মানবতার পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান।”
অভিযোগ থেকে রায় পর্যন্ত দীর্ঘ পথচলা
২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট, গণঅভ্যুত্থানের পর হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ জমা পড়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায়।
তদন্ত শেষে ২০২৫ সালের ১২ মে প্রতিবেদন জমা হয়, এবং ১ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দাখিল করা হয়।
পরে ১০ জুলাই ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে।
এই মামলার বিচার কার্যক্রমে রাষ্ট্রপক্ষের ৮১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৪ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন—তাদের মধ্যে ছিলেন অভিযুক্ত আবদুল্লাহ আল-মামুন ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
অভিযোগপত্রটি ১৩৫ পৃষ্ঠার; সঙ্গে জমা হয় ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার প্রমাণ ও নথিপত্র—যা বাংলাদেশের বিচার ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ দলিল।
যে অভিযোগে বিচার
রাষ্ট্রপক্ষের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি বড় অভিযোগের মধ্যে রয়েছে—
1️⃣ গণভবনে উসকানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে সহিংসতা উসকে দেওয়া,
2️⃣ হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান,
3️⃣ রংপুরে ছাত্র আবু সাঈদের হত্যা,
4️⃣ চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা,
5️⃣ আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা ও লাশ পুড়িয়ে ফেলা।
প্রতিটি ঘটনায় রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেছে, আসামিরা নির্দেশ, প্ররোচনা, সহায়তা ও নেতৃত্বের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন।
বিচারের মানবিক প্রেক্ষাপট
গণঅভ্যুত্থানের সময় দেশের রাস্তায় রক্ত, ধোঁয়া ও ভয় একাকার হয়েছিল।
রংপুরে নিহত ছাত্র আবু সাঈদের মা এক সাক্ষ্যে বলেন,
“ছেলেটা শুধু পতাকা হাতে রাস্তায় গিয়েছিল। ফিরে এল না। আজ যদি আদালত ন্যায় দেয়, তবেই তার আত্মা শান্তি পাবে।”
চানখাঁরপুল ও আশুলিয়ার বেঁচে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীরাও আদালতে বলেন, সেদিনের গুলির শব্দে শুধু মানুষ নয়, একটি প্রজন্ম কেঁপে উঠেছিল।
এই সাক্ষ্যগুলো শুধু আইনি দলিল নয়—একটি জাতির মানবিক স্মৃতি।
একটি সমাজ কতটা ব্যথা সয়ে উঠে দাঁড়ায়, সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে এই বিচার।
আইন বনাম নৈতিক দায়
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হন।
বিশ্লেষকরা বলছেন,
“এই রায় হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নৈতিক বাঁক—যেখানে ক্ষমতার উচ্চচূড়ায় থাকা কেউও আইনের ঊর্ধ্বে নয়।”
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ভাষায়,
“এই মামলা কেবল হাসিনার নয়—এটি রাষ্ট্র বনাম নিষ্ঠুরতা, ক্ষমতা বনাম মানবতা।”
মানবিক ও ঐতিহাসিক প্রতিফলন
বাংলাদেশের ইতিহাসে গণঅভ্যুত্থান সব সময়ই এসেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ হয়ে।
কিন্তু ২০২৪ সালের সেই আন্দোলন ও পরবর্তী দমন-পীড়নের সময়কার দৃশ্যগুলো—দগ্ধ লাশ, আতঙ্কিত মা, আহত তরুণ—জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছিল।
আজ, সেই জাতি আদালতের দিকে তাকিয়ে আছে ন্যায়বিচারের আশায়।
এই মামলার রায় শুধু তিনজন আসামির ভাগ্য নির্ধারণ করবে না; এটি নির্ধারণ করবে—
বাংলাদেশ কি সত্যিই মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে পারছে, নাকি রাজনৈতিক দায়মুক্তির পুরোনো চক্র আবারও ফিরে আসছে।
শেষ কথা: রায় হবে ইতিহাসের আয়না
১৭ নভেম্বরের রায় তাই কেবল আদালতের সিদ্ধান্ত নয়—এটি ইতিহাসের রায়।
একটি জাতি তার অতীতের মুখোমুখি হতে চলেছে।
যেখানে প্রশ্ন একটাই—
“ক্ষমতার নামে যারা নিরপরাধ মানুষ হত্যা করেছে, তারা কি আজ ন্যায়বিচারের মুখ দেখবে?”
যে দিনটি আসছে, সেটি কেবল রায় ঘোষণার দিন নয়—
এটি বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ও মানবতার প্রতিশ্রুতি পুনঃনিশ্চিত করার দিন।
পাঠকের মন্তব্য