বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ১৯৪৭ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত জামায়াতের কোনো কর্মকাণ্ডে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে তিনি তাঁদের কাছে বিনা শর্তে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে স্থানীয় সময় বুধবার (২২ অক্টোবর) নিউইয়র্কে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে কোয়ালিশন অব বাংলাদেশি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন (কোবা)। এতে সাংবাদিক, প্রবাসী নাগরিক এবং জামায়াতের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
শফিকুর রহমানের বক্তব্য ছিল আবেগঘন ও আত্মসমালোচনামূলক—যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল এক উদাহরণ।
তিনি বলেন,
“সাতচল্লিশ থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের আজ ২২ অক্টোবর রাত ৮টা ১১ মিনিট পর্যন্ত আমাদের দ্বারা কেউ যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন, আমরা বিনা শর্তে তাঁদের কাছে মাফ চাই। এটা গোটা জাতি হলেও চাই, ব্যক্তি হলেও চাই।”
এই বক্তব্যে তিনি কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং দলীয়ভাবে একটি ঐতিহাসিক দায় স্বীকারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
‘আমরা মানুষ, ভুল হতেই পারে’
জামায়াতের আমির বলেন,
“আমরা মানুষ। আমাদের সংগঠন মানুষের সংগঠন। আমাদের ১০০টি সিদ্ধান্তের মধ্যে ৯৯টি সঠিক হলেও একটি বেঠিক হতে পারে। সেই ভুলের জন্য জাতির ক্ষতি হলে মাফ চাইতে লজ্জা কিসে?”
তিনি আরও বলেন,
“আমার কোনো সহকর্মী বা সিনিয়র কখনও বলেননি যে আমরা ভুলের ঊর্ধ্বে। যে দল এমন দাবি করে, জাতি তা মেনে নেয় না। আমাদের যত ভুল হয়েছে—জানা বা অজানা—যাঁরা শুধরে দিয়েছেন, আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। আর এই ভুলের দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, আমরা তাঁদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
একাত্তরের ভূমিকা প্রসঙ্গে
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে শফিকুর রহমান বলেন,
“একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা ছিল। আমরা তখন মনে করেছিলাম পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত। তবে ইতিহাসকে কেবল একপাক্ষিকভাবে দেখা ঠিক নয়। সেই সময় আওয়ামী লীগের বহু নেতা পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকরি করেছেন, বেতন ও রেশন নিয়েছেন। তখনকার পরিস্থিতি ছিল জটিল।”
তবে এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই তিনি স্বীকার করেন যে, অতীতের কিছু সিদ্ধান্ত জাতির ক্ষতি করেছে, এবং আজ সময় এসেছে সেই ভুলের দায় মেনে নেওয়ার।
‘জাতির প্রতি নৈতিক দায়িত্ব’
শফিকুর রহমান বলেন,
“যে জাতির সঙ্গে বাস করি, সেই জাতির কাছেই দায়বদ্ধ আমরা। যদি আমাদের কোনো কর্মকাণ্ডে মানুষের কষ্ট হয়ে থাকে, তবে সেই কষ্টের জন্য ক্ষমা চাওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”
তিনি যোগ করেন,
“জামায়াত ইসলামী কোনো সময়ই নিজেকে নির্ভুল দাবি করেনি। ইতিহাসের ভুল শুধরে নেওয়া মানে অতীত মুছে ফেলা নয়; বরং সেটিকে শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা।”
অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত অনেকে এই বক্তব্যকে “দায় স্বীকারের এক সাহসী পদক্ষেপ” বলে উল্লেখ করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ: নতুন দিকের সূচনা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতের এই নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
একজন সিনিয়র রাজনৈতিক গবেষক বলেন,
“বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেউ খুব সহজে নিজের ভুল স্বীকার করেন না। শফিকুর রহমানের বক্তব্য মানবিক ও নৈতিক নেতৃত্বের উদাহরণ হতে পারে—যদি তা শুধু মুখের কথা না থেকে সংগঠনের কর্মপন্থায় প্রতিফলিত হয়।”
অনেকে মনে করেন, এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে জামায়াত তাদের অতীত ভুলের দায় মেনে নিয়ে একটি পুনর্মিলনের রাজনীতি শুরু করতে পারে—যেখানে থাকবে সহমর্মিতা, মানবিকতা এবং জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা।
অতীতের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস
ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্য কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং মানবিক আহ্বানও বটে। বাংলাদেশের সমাজে বিভাজন, ঘৃণা ও প্রতিশোধের রাজনীতি যে ক্ষত তৈরি করেছে, সেটি সারাতে এই ধরনের মানবিক স্বীকারোক্তি হতে পারে ইতিবাচক পদক্ষেপ।
তিনি বলেন,
“আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি। জাতির ঐক্যের স্বার্থে সবাইকে একত্র হতে হবে। বিভাজন নয়, সংলাপই হতে হবে আমাদের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা।”
উপসংহার
শফিকুর রহমানের এই ক্ষমা প্রার্থনা হয়তো এক মুহূর্তে অতীতের ভুল মুছে দিতে পারবে না। তবে এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি মানবিক মাইলফলক হয়ে থাকতে পারে—যেখানে দায় স্বীকার, ক্ষমা চাওয়া এবং পুনরায় সম্পর্ক গড়ে তোলার আহ্বান মিলেমিশে যায়।
পাঠকের মন্তব্য