জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ঐতিহাসিক ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শুরুর আগেই তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীতে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে ‘জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয়ে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল ও আগুনের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পুরো সংসদ ভবন এলাকা।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, আসাদগেট, ধানমন্ডি ২৭ ও খামারবাড়ি মোড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এই সংঘাতের রেশ। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়।
বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের সূচনা
আজ শুক্রবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে ‘জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধা’ ব্যানারে শতাধিক মানুষ জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জড়ো হন। মঞ্চের সামনেই তারা অবস্থান নেন। অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই একই রঙের পোশাক ও টুপি পরা অবস্থায় স্লোগান দিতে থাকেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দিতে শুরু করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়, পুলিশের লাঠিচার্জে অন্তত কয়েকজন আহত হন, যাদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যখন বিক্ষোভকারীরা পাল্টা ইটপাটকেল ছোড়ে ও আগুন ধরিয়ে দেয় কিছু আসবাবপত্রে।
বেলা আড়াইটার দিকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর, আসাদগেট ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ এলাকায়। রাস্তায় টানা কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে সংসদ ভবনের সামনের সড়কে।
পুলিশের বক্তব্য
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার মো. শহীদুল্লাহ জানিয়েছেন, “পুলিশের ওপর হামলা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। অন্তত পাঁচটি পুলিশ গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। আমরা আত্মরক্ষার্থে সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করেছি এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি।”
তবে স্থানীয়দের দাবি, পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের কারণেই সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে। একজন বিক্ষোভকারী রুবেল বলেন, “আমাদের ওপর অকারণে সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়। আমাদের অনেকে আহত হয়েছে।”
সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যদের আসাদগেট ও সংসদ ভবন সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নিতে দেখা যায়। বিজিবি, পুলিশ, এপিবিএন ও স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সদস্যরা পুরো সংসদ ভবন এলাকা ঘিরে রাখেন। বিকেলে যান চলাচল বন্ধ থাকলেও সন্ধ্যার আগে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
তবে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে তখনও যান চলাচল সীমিত ছিল। স্থানীয় দোকানপাটের অনেকগুলো বন্ধ দেখা যায়, আতঙ্কে অনেকে ঘর থেকে বের হননি।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বিকেল ৫টায় দক্ষিণ প্লাজায় নির্ধারিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি দল এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।
তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আগেই ঘোষণা দেয়, “আইনি ভিত্তি ও পূর্ণাঙ্গ খসড়া না পাওয়া পর্যন্ত তারা সনদে স্বাক্ষর করবে না।” একই অবস্থান জানায় বাম ধারার চারটি দল — সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ।
এই বিভক্ত অবস্থান ও জুলাই আন্দোলনের দাবিদারদের ক্ষোভ মিলিয়েই উত্তেজনার জন্ম হয় সংসদ ভবন চত্বরে।
মানবিক প্রেক্ষাপট
আজকের সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে অনেকে ‘জুলাই যোদ্ধা’ আন্দোলনের পুরনো কর্মী বলে দাবি করেছেন। তাদের বক্তব্য, “আমরা শুধু স্বীকৃতি চাই। আমাদের আত্মত্যাগের কথা কেউ স্বীকার করে না।”
একজন আহত নারী অংশগ্রহণকারী বলেন,
“আমার ভাই জুলাই আন্দোলনে পঙ্গু হয়েছে। আজ যখন আমরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিতে চেয়েছি, তখন আমাদের ওপর লাঠিপেটা করা হলো।”
এই বক্তব্যগুলো আজকের ঘটনার মানবিক দিকটি স্পষ্ট করে তুলে ধরে — যেখানে রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রাক্কালে সেই আন্দোলনের অংশীদাররাই আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন।
উপসংহার
জুলাই সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঐকমত্যের নতুন অধ্যায় সূচিত হলেও আজকের এই রক্তাক্ত ঘটনাপ্রবাহে সেই ঐক্যের আলো যেন কিছুটা ম্লান হয়ে গেল। এখন প্রশ্ন উঠছে — যে সনদ মানুষের অধিকার ও শান্তির প্রতীক হিসেবে ঘোষিত, তার প্রথম দিনেই কেন রাস্তায় রক্ত ঝরল?
পাঠকের মন্তব্য