রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা নীলক্ষেত ও নিউমার্কেট। শিক্ষার্থী, দোকানদার, ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা—সবাই মিলে প্রতিদিন যে জীবনের স্রোত তৈরি করেন, সেটি হঠাৎই থমকে গেল রবিবার (১২ অক্টোবর) মধ্যরাতের অন্ধকারে।
একটি ফুটপাতের দোকান বসানোকে কেন্দ্র করে শুরু হয় উত্তেজনা, যা দ্রুতই রূপ নেয় ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে বিভ্রান্তি ও ভয়।
রাত বাড়তে থাকলে পুরো এলাকা ইট-পাটকেলে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়।
যেখানে কিছুক্ষণ আগেও তরুণদের হাসি–ঠাট্টা ছিল, সেখানে মুহূর্তেই ভেসে আসে আতঙ্কের চিৎকার। দোকান বন্ধ হয়, রিকশাওলা ঘুরে দাঁড়ায়, আর এলাকার সাধারণ মানুষ খোঁজে নিরাপদ আশ্রয়।
শিক্ষার্থীদের মানবিক আবেদন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি সাদিক কায়েমসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তাঁরা মাইকে শান্তির আহ্বান জানান, বলেন—
“আমরা সবাই একই শহরের সন্তান। সামান্য ভুল বোঝাবুঝি যেন মানুষের জীবনের ঝুঁকি না বাড়ায়।”
তাঁদের এমন আহ্বানে অনেকে পিছু হটলেও, কিছু ক্ষণে আবারও ছুটে আসে ইট-পাটকেল।
সেখানেই উঠে আসে বড় প্রশ্ন—শিক্ষার্থীরা কি এখনো নিরাপদ?
পুলিশের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ
ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত নীলক্ষেত ও নিউমার্কেট এলাকায় মোতায়েন হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নিউমার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর গণমাধ্যমকে জানান,
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহনেওয়াজ হলের সামনে ফুটপাতে দোকান বসানোকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত উভয় পক্ষকে সরিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।”
তিনি আরও বলেন, ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। আইনগত প্রয়োজন দেখা দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মানুষের দৃষ্টিকোণ: ভয়ের শহর, থেমে যাওয়া শ্বাস
সেই রাতের ঘটনায় সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয়।
নীলক্ষেতের এক দোকান কর্মচারী বলেন,
“আমরা দোকান বন্ধ করে দৌড় দিই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারদিক অন্ধকার আর আতঙ্ক।”
রিকশাচালক আজিজ মিয়া জানান,
“আমরা ভয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু মন খারাপ লাগে—এই তরুণরা তো দেশের ভবিষ্যৎ, তারা একে অপরের বিপক্ষে দাঁড়ায় কেন?”
এই কথাগুলোর মধ্যেই ধরা পড়ে নগরজীবনের গভীর মানবিক বার্তা—
যখন প্রতিদিনের সংগ্রামের ভেতরেও মানুষ মানুষকে জায়গা দেয় না, তখন শহর কেবল ইট–বালুর নয়, অনিশ্চয়তার প্রতীক হয়ে ওঠে।
সংঘর্ষের অন্তরালে: সামাজিক বাস্তবতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের সংযোগ এলাকাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই ফুটপাত দখল, দোকান বসানো, রাস্তা অবরোধ ও জায়গা ভাগাভাগি নিয়ে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু।
দীর্ঘদিনের অদৃশ্য উত্তেজনা প্রায়ই ছোট একটি ঘটনাকে বড় সংঘর্ষে পরিণত করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসনের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও নিয়মিত সংলাপের আয়োজন করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা বিকল্প চিন্তা ও সহমর্মিতার চর্চায় অভ্যস্ত হয়।
মানবিক সমাধানের আহ্বান
ঘটনার পর পুলিশের নিয়ন্ত্রণে এলেও, এলাকায় এখনো উদ্বেগের বাতাস বইছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলেছেন—
“আমরা চাই নিরাপত্তা, কিন্তু তার চেয়েও বেশি চাই পারস্পরিক সম্মান।”
স্থানীয় দোকানদাররা জানান,
“আমরা রুটি-রুজির জন্য দোকান বসাই, কারও ক্ষতি করতে চাই না। প্রশাসন যদি একটা নির্দিষ্ট জায়গা দেয়, তাহলে সমস্যা মিটে যায়।”
এই আহ্বানগুলোর ভেতরেই লুকিয়ে আছে সমাধানের পথ—বোঝাপড়া, যোগাযোগ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির শক্তি।
উপসংহার
নীলক্ষেতের এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—
একটি শহর শুধু উন্নয়ন প্রকল্প বা ইটের ভবনে গড়া হয় না; এটি গড়ে ওঠে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা এবং সংলাপের ভিত্তিতে।
যখন আমরা মানবিকতা হারাই, তখন ছোট ভুলও বড় ট্র্যাজেডি হয়ে যায়।
পাঠকের মন্তব্য