একসময় মানুষ অপেক্ষা করত ডাকপিয়নের সাইকেলের ঘণ্টার শব্দের জন্য। কারণ সেই শব্দ মানেই প্রিয়জনের খোঁজ, সুখ-দুঃখের খবর, কিংবা ভালোবাসার চিঠি এসে পৌঁছেছে।
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা লাল রঙের ডাকবাক্সগুলো ছিল তখন মানুষের যোগাযোগের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।
কিন্তু সময় বদলে গেছে। প্রযুক্তির ঝড় এসে সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। এখন সেই ডাকবাক্সগুলো পড়ে আছে নির্জন, মরিচায় ক্ষয়ে যাওয়া অতীতের নিদর্শন হয়ে।
চিঠির যুগ থেকে ডিজিটাল সময়
যেখানে একসময় মানুষ কলম হাতে বসত প্রিয়জনের খোঁজখবর জানাতে, আজ সেখানে আঙুলের ছোঁয়ায় পাঠানো হয় ই-মেইল, মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা।
যোগাযোগের এই দ্রুততা মানুষকে কাছে এনেছে ঠিকই, কিন্তু কাগজে লেখা আবেগ, হাতে আঁকা অক্ষরের উষ্ণতা, আর অপেক্ষার রোমাঞ্চ—সবই হারিয়ে গেছে প্রযুক্তির ভিড়ে।
লালমনিরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে একসময় ডাকবাক্স ছিল পরিবারের প্রতিদিনের অংশ। কিশোররা প্রতিযোগিতা করত—কে আগে গিয়ে চিঠি ফেলবে!
কিন্তু এখন সেই ডাকবাক্সগুলো পড়েছে অবহেলায়। অনেকগুলো ভাঙাচোরা, অনেকগুলোতে রঙ উঠে গেছে।
পোস্ট অফিসে আর আগের সেই ব্যস্ততা নেই
লালমনিরহাট জেলা পোস্টমাস্টার নূরনবী জানান,
“এই জেলায় ৮১টি পোস্ট অফিস আছে। নিয়মিত ডাকবাক্স খোলা হয়, কিন্তু আগের মতো আর কেউ চিঠি ফেলে না। এখন শুধু অফিস-আদালতের কাগজপত্র ও ডাকবীমার কাগজই আসে।”
একসময় ডাকবাক্স ছিল যোগাযোগের প্রাণ। এখন তা শুধু নিয়মরক্ষার অংশমাত্র।
সম্পর্কের দূরত্ব বেড়েছে প্রযুক্তির গতিতে
ডাকবাক্স ছিল শুধু একটি বাক্স নয়, এটি ছিল ভালোবাসা ও মায়ার প্রতীক।
যে চিঠির কাগজে শুকিয়ে যেত ফুলের পাপড়ি, থাকত চোখের জল আর মিষ্টি অপেক্ষা—সেই চিঠিগুলোই একসময় গড়ে তুলেছিল সম্পর্কের সেতুবন্ধন।
আজ সেই সম্পর্কের জায়গা নিয়েছে দ্রুত বার্তা, ইমোজি আর ভয়েস নোট। সময় বাঁচে, কিন্তু হারিয়ে গেছে অনুভবের উষ্ণতা।
হারিয়ে যাওয়া এক সময়ের সাক্ষী
লালমনিরহাট, আদিতমারী, হাতীবান্ধা কিংবা কালীগঞ্জের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের পোস্ট অফিসের পাশে এখনো কিছু পুরনো ডাকবাক্স দাঁড়িয়ে আছে—মরিচায় ক্ষয়ে যাওয়া লালচে দেহে।
সেগুলো যেন চুপচাপ তাকিয়ে থাকে পথে চলা মানুষদের দিকে, হয়তো ভাবছে—
“আর কেউ কি কখনও আমার ভেতরে চিঠি ফেলবে?”
সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া এই লাল ডাকবাক্স এখন ইতিহাসের অংশ, অথচ একসময় সেটিই ছিল মানুষের আবেগ, ভালোবাসা ও জীবনের অপরিহার্য যোগাযোগ মাধ্যম।
শেষ কথা
প্রযুক্তির যুগে চিঠি হয়তো অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে,
কিন্তু মানুষের অনুভূতি, অপেক্ষা আর সম্পর্কের গল্পগুলো এখনো বন্দি আছে সেই নিঃশব্দ লাল বাক্সের ভেতরে।
যে বাক্সগুলো একসময় হাসি-কান্নার গল্প পৌঁছে দিত ঘরে ঘরে, আজ সেগুলো কেবল স্মৃতির নিদর্শন।
পাঠকের মন্তব্য