রাজশাহীর নওহাটা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের এক তরুণ বাবা (২৬) এপ্রিল মাসে তাঁর নবজাতকের জন্মনিবন্ধনের আবেদন করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ জানান—মায়ের বয়স ১৮ বছরের কম, তাই সন্তানের জন্মনিবন্ধন সম্ভব নয়।
অপেক্ষার প্রহর শেষে স্ত্রী ১৮ পূর্ণ হওয়ার পরেই তাঁদের সন্তানের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়। কিন্তু অনেকেরই এমন সৌভাগ্য হয়নি।
এই এক দম্পতির অভিজ্ঞতাই আজ সারাদেশের বহু পরিবারের বাস্তব চিত্র—যেখানে বাল্যবিবাহের শিকার মা–বাবার সন্তানরা জন্মনিবন্ধনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
‘বিডিআরআইএস’ সিস্টেমের সীমাবদ্ধতা
এ বছরের এপ্রিল থেকে ‘বিডিআরআইএস’ (Birth and Death Registration Information System) সফটওয়্যারে নতুন নিয়ম চালু হয়।
মায়ের বয়স ১৮ বছরের কম
বাবার বয়স ২১ বছরের কম
হলে সন্তানের জন্মনিবন্ধনের আবেদন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায়।
কর্তৃপক্ষ জানায়, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭–এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতেই এই শর্ত যোগ করা হয়েছিল।
কিন্তু এর ফলে জন্মনিবন্ধন—যা একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার, তা থেকে বহু শিশু বঞ্চিত হয়ে পড়ে।
টিকার জন্য ‘ছাড়’, কিন্তু সাময়িক
বর্তমানে সরকার ১২ অক্টোবর থেকে টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, যেখানে ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী প্রায় ৫ কোটি শিশুকে টিকা দেওয়া হবে।
কিন্তু জন্মনিবন্ধন ছাড়া টিকার নিবন্ধন সম্ভব নয়। ফলে বাধ্য হয়েই কর্তৃপক্ষ অক্টোবর পর্যন্ত বয়সের সীমা ১৬ বছর করার সাময়িক ছাড় দিয়েছে।
রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন জানিয়েছেন,
“অক্টোবর পর্যন্ত ১৬ বছর বয়সী মা–দের সন্তানের জন্মনিবন্ধন করা যাবে। এরপর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাগরিক অধিকারকে শর্তসাপেক্ষ করা সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
‘আইনের অপব্যাখ্যায়’ বঞ্চিত শিশুরা
জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের কান্ট্রি কো–অর্ডিনেটর মো. নজরুল ইসলাম বলেন,
“জন্মনিবন্ধন আইন অনুযায়ী, কোনো শিশুকে বাদ দেওয়া যাবে না।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অন্য পথ নিতে হবে—শিশুর অধিকার কেড়ে নয়।”
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ অনুযায়ী, দেশে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার ৫০%।
আর ইউএনএফপিএর তথ্যমতে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রতি হাজার মেয়ের মধ্যে ৭১ জন ইতিমধ্যে মা।
অর্থাৎ বাস্তবতার সঙ্গে আইনি কাঠামোর অসামঞ্জস্য এখন শিশুদের নাগরিক অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলছে।
প্রশাসনিক চিঠি চালাচালি ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বিষয়টি নিয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেলকে অবহিত করেন।
এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে নির্দেশ আসে—
বাবা-মায়ের বয়সজনিত কারণে যেন কোনো সন্তানের জন্মনিবন্ধন আটকে না যায়।
তবে এখনো পর্যন্ত এটি “অস্থায়ী সমাধান”। অক্টোবরের পর আবারও বয়সের বাধা ফিরতে পারে।
আইন বনাম মানবিক বাস্তবতা
আইন বলছে—বাল্যবিবাহ বেআইনি।
কিন্তু বাস্তব বলছে—বাল্যবিবাহের শিকার মা–বাবার সন্তানরা কোনো অপরাধ করেনি, তবু তারাই নাগরিক পরিচয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাধান হলো
-
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি
-
বিয়ের অনলাইন নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা
-
এবং কোনো শিশুর অধিকার যেন প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতায় আটকে না যায়, তা নিশ্চিত করা।
উপসংহার: নাগরিক পরিচয়ের অধিকার সবার জন্য
জন্মনিবন্ধন শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক কাগজ নয়; এটি শিশুর নাগরিক পরিচয়, টিকা, শিক্ষা ও ভবিষ্যতের রাষ্ট্রীয় সেবা পাওয়ার প্রথম সিঁড়ি।
আইনের ব্যাখ্যা যতই কঠোর হোক, অধিকার যেন কোনো শিশুর কাছে অপরাধের শাস্তি না হয়ে যায়—এই দাবিই আজ দেশের হাজারো অভিভাবকের।
পাঠকের মন্তব্য