খাগড়াছড়ি পাহাড়ি জনপদ গত এক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনায় ভুগছে। একটি কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত সহিংসতায় রূপ নেয় এবং প্রাণ কেড়ে নেয় তিন তরুণের। আহত হয়েছেন সেনা ও পুলিশ সদস্যসহ অনেকে। তবে সর্বশেষ মেডিকেল পরীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই শিক্ষার্থীর দেহে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতালে মেডিকেল বোর্ডের প্রধান, সিনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি) ডা. জয়া চাকমা জানান, “আমরা সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। ধর্ষণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।” এ মেডিকেল বোর্ডে আরও ছিলেন ডা. মীর মোশাররফ হোসেন ও ডা. নাহিদ আক্তার।
পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদন হাতে পেয়ে জানান, ধর্ষণের কোনো আলামত মেলেনি। তিনি আরও বলেন, “এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে যেভাবে সহিংসতা ছড়ানো হলো, তা পরিকল্পিত। এতে তিনটি প্রাণ ঝরে গেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
সহিংসতার কালো অধ্যায়
গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে খাগড়াছড়ি সদরের সিঙ্গিনালা এলাকায় বাড়ি ফেরার পথে ওই কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় ক্ষেত থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে শয়ন শীল (১৯) নামে এক তরুণকে আটক করে পুলিশ।
পরদিন থেকেই পাহাড়ি এলাকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। সাত দিন ধরে অবরোধ, মিছিল, বিক্ষোভ চলতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়। কিন্তু তাতেও উত্তেজনা থামেনি। সর্বশেষ রবিবার গুইমারায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণ হারান তিন পাহাড়ি যুবক। আহত হন তিন সেনা কর্মকর্তা, ১৩ সেনা সদস্য ও পুলিশের ওসি-সহ আরও কয়েকজন।
পরিবার ও জনপদের আহাজারি
সহিংসতায় প্রাণ হারানো যুবকদের পরিবারের আহাজারি এখন গোটা জনপদকে ভারী করে রেখেছে। স্থানীয়দের দাবি, একটি অভিযোগকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের ব্যর্থতায় এই দুঃখজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাদের কথায়, “আমরা বিচার চাই, সহিংসতা নয়।”
তদন্ত কমিটি
গুইমারার এই সহিংস ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন। মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
মানবিক দৃষ্টিকোণ
একটি কিশোরীর প্রতি অন্যায় অভিযোগ ও তার পরবর্তী সহিংসতা শুধু প্রাণ কেড়ে নেয়নি, বরং পাহাড়ি-বাঙালি মানুষের সহাবস্থানে ভয়াবহ ক্ষত তৈরি করেছে। যে পরিবারগুলো তাদের সন্তান হারিয়েছে, তাদের চোখের জল পাহাড়ি জনপদের প্রতিটি গাছ-গাছালিকে যেন কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এখন সময় এসেছে, সত্য উদঘাটন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সহিংসতার পথ থেকে সমাজকে ফিরিয়ে আনার।
পাঠকের মন্তব্য