খাগড়াছড়ির গুইমারায় সাম্প্রতিক সহিংসতা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জীবনে নতুন করে শোক ও আতঙ্ক নেমে এনেছে। তিনজন পাহাড়ি মানুষের প্রাণহানি, অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত দোকানপাট, ভিটেমাটি হারানো পরিবার এবং আহতদের আর্তচিৎকার গোটা জনপদকে শোকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এ ঘটনার তদন্তে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে প্রশাসন।
মঙ্গলবার দুপুরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার। তিনি নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং বলেন, “আমরা শুধু প্রশাসন হিসেবে নয়, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছি। পুনর্বাসন ও চিকিৎসার দায়িত্ব প্রশাসনই নেবে।”
প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি
পরিদর্শনের সময় ক্ষতিগ্রস্তরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিজেদের দুর্দশার কথা জানান। অনেকের দোকানপাট আগুনে ছাই হয়ে গেছে, কেউবা আহত স্বজনের জীবন বাঁচাতে হাসপাতালের শয্যার পাশে ছুটছেন।
ডিসি বলেন, “অবরোধকারীদের দেওয়া আট দফা দাবির মধ্যে সাতটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আলোচনার টেবিলে সমাধান সম্ভব। তারা যদি অবরোধ প্রত্যাহার করেন, আমরাও দ্রুত ১৪৪ ধারা তুলে নেব।”
পাশাপাশি তিনি সহিংসতায় ভস্মীভূত পরিবারগুলোর ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও চিকিৎসা সহায়তার আশ্বাস দেন।
পুলিশের বক্তব্য
খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেন, “গুইমারার ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে মামলা করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। যদি তারা মামলা করতে না চান, তবে পুলিশ নিজেই বাদী হয়ে মামলা করবে। অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।”
পরিস্থিতি এখনও অস্বস্তিকর
টানা চতুর্থ দিনের মতো খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
-
শহরের ভেতরে কিছু টমটম ও জরুরি যানবাহন চলছে।
-
দূরপাল্লার যান চলাচল না থাকায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন পর্যটকরা।
-
জেলার বাজারে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
-
তবে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে পুরো এলাকায়।
ঘটনার সূত্রপাত
এই সহিংসতার শুরু এক কিশোরীকে অচেতন অবস্থায় ক্ষেত থেকে উদ্ধার করার ঘটনাকে ঘিরে। ওই কিশোরীর বাবা ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করলে পুলিশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় একজনকে গ্রেপ্তার করে।
ঘটনার পরপরই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ধর্ষণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয়, যা দ্রুত সহিংসতায় রূপ নেয়। রোববার ১৪৪ ধারার মধ্যেও গুইমারায় ভয়াবহ সংঘর্ষ ঘটে। এ সময় গুলিতে তিনজন নিহত হন এবং বহু দোকানপাট ও বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
মানবিক বিপর্যয়
গুইমারার পরিবারগুলো এখন চরম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। কেউ প্রিয়জন হারিয়ে শোকে বিহ্বল, কেউ আবার মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত এক দোকান মালিক চোখ মুছতে মুছতে বলেন, “আমার দোকানটা ছিল সংসারের ভরসা। এক রাতেই সব শেষ হয়ে গেল। এখন পরিবার নিয়ে কোথায় যাব?”
এক স্বজনহারা নারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার ছেলে তো আর ফিরবে না। কিন্তু আমি চাই যারা এভাবে আমাদের জীবন কেড়ে নিল, তাদের বিচার হোক।”
উপসংহার
খাগড়াছড়ির এই সহিংসতা শুধু কয়েকটি পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে দেয়নি, বরং গোটা পার্বত্য জনপদে শোক ও অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলেছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিশ্রুতি দিলেও সাধারণ মানুষ এখনো আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো — শান্তি প্রতিষ্ঠা, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনা।
পাঠকের মন্তব্য