বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিন্তক, প্রবীণ রাজনীতিক এবং সমাজবিজ্ঞানের বিশিষ্ট গবেষক বদরুদ্দীন উমর ৭ সেপ্টেম্বর, রোববার সকাল ১০টা ৫ মিনিটে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এই দুঃখজনক সংবাদ নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, সকালেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বদরুদ্দীন উমর, পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেন, তবে শেষ পর্যন্ত তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতিবিদ এবং একজন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী। তার গবেষণা ও বিশ্লেষণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শুধু একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, বরং তার লেখালেখির মাধ্যমে তিনি সমাজের নানা সমস্যা, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে গভীর চিন্তা করেছেন।
বদরুদ্দীন উমরের জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরে। তার পিতা আবুল হাশিম ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এবং প্রগতিশীল মুসলিম লীগ নেতা। তার পরিবারের ইতিহাসও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ১৯৫০ সালে পারিবারিক কারণে তিনি এবং তার পরিবার ঢাকা চলে আসেন। এরপর, ১৯৫২ সালে, ভাষা আন্দোলনে উমর এবং তার পিতা উভয়েই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন
বদরুদ্দীন উমর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন এবং সেখানে কিছুদিন একটি গবেষণা প্রকল্পে কাজ করেন। তার পর, ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজের দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি ইংল্যান্ড যান এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন্স কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন এবং অর্থশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন।
দেশে ফিরে তিনি আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্বও তিনি গ্রহণ করেন। এরপর, ১৯৬৮ সালে, তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে সরাসরি বিপ্লবী রাজনীতিতে যোগ দেন। এই সময় তার রাজনৈতিক চিন্তা এবং লেখালেখি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।
রাজনৈতিক জীবন ও মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত তিনি গণশক্তি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, তিনি পার্টির বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন এবং এতে মতাদর্শগত কারণে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (ইপিসিপি) থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর, তিনি বাংলাদেশের বামপন্থি আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের প্রসারে জোর দিয়েছিলেন।
বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশ লেখক শিবির, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে তাদের কাজ পরিচালনা করেছিলেন এবং বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংগঠন ও নেতৃত্ব গড়ে তুলেছিলেন।
গবেষণা ও লেখালেখি
বদরুদ্দীন উমর ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক এবং গবেষক। তার গবেষণামূলক কাজের মধ্যে রয়েছে “পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি” (তিন খণ্ডে), “সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা”, “পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতি”, “বাঙালীর সমাজ ও সংস্কৃতির রূপান্তর”, “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ” এবং “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক” ইত্যাদি। তার এই গবেষণাগুলি বাংলাদেশের ইতিহাস ও সমাজের গভীর দিকগুলি নিয়ে আলোকপাত করেছে।
স্বাধীনতা পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি
চলতি বছর, সরকার বদরুদ্দীন উমরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। তবে, বদরুদ্দীন উমর এই পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, “১৯৭৩ সাল থেকে আমাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আমি সেগুলোর কোনোটি গ্রহণ করিনি। এখন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেছে। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ। কিন্তু তাদের দেওয়া এই পুরস্কারও গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
উমরের অবদান ও শূন্যতা
বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যু দেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে এক বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। তার বিশ্লেষণধর্মী লেখনীর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তার চিন্তাধারা এবং গবেষণামূলক কাজ আগামী প্রজন্মের জন্য এক মূল্যবান ঐতিহ্য হয়ে থাকবে।
এভাবে, বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যু বাংলাদেশের এক উজ্জ্বল চিন্তকের হারানোর শোক বয়ে আনল। তার কাজ এবং অবদান চিরকাল আমাদের স্মরণে থাকবে।
পাঠকের মন্তব্য