এন্ট্রেপ্রেনিউর বাংলাদেশ ডেস্ক
বাংলাদেশের স্থাপত্যের এক নতুন দিগন্ত
প্রথমবারের মতো, একটি বাংলাদেশি স্থাপত্য নিদর্শন জায়গা করে নিয়েছে TIME Magazine-এর World’s Greatest Places তালিকায়। এটি শুধু বাংলাদেশের স্থাপত্যের জন্য গর্বের বিষয়ই নয়, বরং দেশের সমসাময়িক নকশা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির এক অনন্য উদাহরণ।
জেবুন্নেছা মসজিদ, যা নকশা করেছেন সাইক্বা ইকবাল মেঘনা, সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, স্টুডিও মরফোজেনেসিস লিমিটেড, শুধুমাত্র একটি স্থাপত্যের কীর্তি নয়—এটি সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, সংস্কৃতি সংবেদনশীলতা এবং স্থাপত্য উদ্ভাবনের প্রতীক।
ঢাকার অদূরে, আশুলিয়ার জামগোরা শিল্প এলাকায় অবস্থিত এই গোলাপি রঙের মসজিদটি প্রচলিত মসজিদ স্থাপত্যের ধারা থেকে বেরিয়ে এসে গ্রহণ করেছে ন্যূনতম নকশা, টেকসই উপাদান ও লিঙ্গসমতার ধারণা। এটি শুধু ইবাদতের স্থান নয়, বরং হাজারো তৈরি পোশাক শ্রমিকদের জন্য মানসিক প্রশান্তির এক আশ্রয়স্থল, যেখানে তারা কর্মজীবনের চাপ থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
এই স্বীকৃতি শুধু বাংলাদেশের স্থাপত্যের গর্বই বাড়ায়নি, বরং এটি প্রমাণ করেছে যে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে স্থাপত্য হতে পারে সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার।
একটি তাৎপর্যপূর্ণ মসজিদ
এই জেবুন্নেছা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন ইদ্রিস শাকুর, আইডিএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আইডিএস অ্যাড্রেস মেকার লিমিটেডের চেয়ারম্যান, এবং মোহাম্মদ আরশাদ, আইডিএস গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এটি তাদের প্রয়াত মা জেবুন্নেছার স্মৃতির প্রতি এক অনন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি। তবে এই প্রকল্পটি শুধুই স্মৃতিস্তম্ভ নয়, বরং এটি গভীর সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন।
এ জে এম সাজেদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আইডিএস অ্যাড্রেস মেকার লিমিটেড, এবং তার দক্ষ টিম অত্যন্ত যত্ন ও নিখুঁত পরিকল্পনার মাধ্যমে জেবুন্নেছা মসজিদ নির্মাণ করেছেন। আইডিএস অ্যাড্রেস মেকার লিমিটেড সবসময় গুণগত মান ও নান্দনিকতার সমন্বয়ে নির্মাণকাজ পরিচালনা করে, যা তাদের প্রতিটি প্রকল্পে প্রতিফলিত হয়।
স্থপতি মেঘনা এই মসজিদটিকে “Soft Shelter” বা শান্তির আশ্রয়স্থল হিসেবে কল্পনা করেছেন, যেখানে ৬,৫০০ পোশাকশ্রমিক এসে প্রার্থনা করতে পারবেন, মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পাবেন এবং নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারবেন।
অনেক প্রচলিত মসজিদে নারীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা রাখা হয় না। কিন্তু জেবুন্নেছা মসজিদ শুরু থেকেই লিঙ্গসমতাকে গুরুত্ব দিয়েছে।
একটি সুন্দর সর্পিল সিঁড়ি একটি ছাতিম গাছকে ঘিরে উঠে গেছে, যা নারীদের জন্য পৃথক নামাজের জায়গায় পৌঁছানোর পথ তৈরি করেছে—এটি বাংলাদেশি মসজিদ স্থাপত্যের ক্ষেত্রে এক বিরল সংযোজন।
“এই স্থানটি যেন সব পোশাক শ্রমিকের জন্য হয়,” বলেন স্থপতি মেঘনা। “যখন মানুষ নিজেকে এই স্থানের মালিক বলে ভাবতে পারে, তখনই স্থপতি হিসেবে আমার কাজ সার্থক।”
ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার সংযোগ
জেবুন্নেছা মসজিদ শুধুই একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি স্থাপত্যের এক অসাধারণ উদ্ভাবন। স্টুডিও মরফোজেনেসিস লিমিটেড-এর স্থপতিরা ইসলামিক স্থাপত্যের প্রচলিত ধারণাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছেন, যেখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা একত্রিত হয়েছে।
প্রধান স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
গোলাপি রঙের সিমেন্টের দেয়াল: এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী টেরাকোটা ও মাটির স্থাপত্যের প্রতি এক সম্মানসূচক সম্মাননা।
ছিদ্রযুক্ত প্রাচীর (Perforated Walls): ঐতিহ্যবাহী জালির নকশা অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে, যা একইসাথে শৈল্পিক ও প্রাকৃতিক বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করে।
স্বচ্ছ কাঁচের মিহরাব: মসজিদের মিহরাব, যা কিবলার দিক নির্দেশ করে, তা স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে তৈরি, যা ধর্মীয় স্থাপত্যে এক সমসাময়িক সংযোজন।
ন্যূনতম নকশার ব্যবহার: অপ্রয়োজনীয় অলঙ্করণ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আলো, বাতাস ও জ্যামিতিক নকশার সংমিশ্রণে এক আত্মিক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।
এই মসজিদটি স্থাপত্যের এক অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে, যেখানে স্থাপত্যের উপাদানগুলি আত্মিক প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিক ভাব জাগিয়ে তোলে।
বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি ও প্রশংসা: বাংলাদেশের স্থাপত্যের জয়যাত্রা
জেবুন্নেছা মসজিদ শুধু বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক স্থাপত্যের ইতিহাসেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এর অনন্য নকশা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তির দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিবেশবান্ধব নকশা এটিকে বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রে এনেছে। TIME Magazine-এর “World’s Greatest Places” তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি অর্জন করেছে, যা বাংলাদেশের স্থাপত্য জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
তবে এই স্বীকৃতি শুধু TIME-এ সীমাবদ্ধ নয়। আরও বেশ কিছু সম্মানজনক পুরস্কার ও মনোনয়ন জেবুন্নেছা মসজিদের স্থাপত্যশৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসা প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম:
৩৪তম জে.কে. স্থপতি সম্মাননা (Foreign Countries’ Architect of the Year) পুরস্কার – এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ স্থাপত্য পুরস্কার, যা সেরা নকশা ও স্থাপত্যবিদ্যার জন্য প্রদান করা হয়।
বিশ্বখ্যাত ডিজাইন প্ল্যাটফর্ম Dezeen-এর শীর্ষ পাঁচটি নাগরিক স্থাপনার মধ্যে মনোনীত – Dezeen হল স্থাপত্য, ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র জগতের অন্যতম প্রভাবশালী প্ল্যাটফর্ম। সেখানে জেবুন্নেছা মসজিদ স্থান পাওয়া প্রমাণ করে যে এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং নাগরিক জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম একটি স্থাপত্য।
ArchDaily-তে বছরের শীর্ষ পাঁচটি ধর্মীয় স্থাপনার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত – ArchDaily বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থাপত্য বিষয়ক ওয়েবসাইটগুলোর একটি। তাদের নির্বাচিত শীর্ষ ধর্মীয় স্থাপনার তালিকায় স্থান পাওয়া মানেই স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম সেরা উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া।
এই সমস্ত অর্জন বাংলাদেশের স্থাপত্যকে বৈশ্বিক মঞ্চে তুলে ধরছে এবং তরুণ স্থপতিদের জন্য এক নতুন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠছে। এটি প্রমাণ করে যে আমাদের দেশেও এমন স্থাপত্য সম্ভাবনা রয়েছে, যা বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করতে সক্ষম।
জেবুন্নেছা মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিচ্ছবি—যেখানে স্থাপত্যশিল্প, মানবকল্যাণ, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির সংমিশ্রণ ঘটেছে। এটি ভবিষ্যৎ স্থপতিদের নতুনভাবে চিন্তা করতে এবং স্থাপত্যকে সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করবে।
নারীদের জন্য স্থাপত্যে নতুন দ্বার উন্মোচন
স্থাপত্যশিল্পে নারী নেতৃত্ব আজও সীমিত। তবে সাইক্বা ইকবাল মেঘনার সাফল্য প্রমাণ করেছে যে নারীরাও নেতৃত্ব দিতে পারে এবং স্থাপত্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
মেঘনার নেতৃত্বে নতুন প্রকল্প
জেবুন্নেছা মসজিদের সফলতার পর, মেঘনা এখন একই শিল্প এলাকায় নারী শ্রমিকদের জন্য একটি কমিউনিটি স্পেস ও ডে-কেয়ার সেন্টার ডিজাইন করছেন।
এটি হবে:
নারী শ্রমিকদের জন্য স্বস্তিদায়ক স্থান
পরিবেশবান্ধব ও টেকসই নির্মাণ
সাশ্রয়ী ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রকল্প
এই প্রকল্পগুলো প্রমাণ করছে যে স্থাপত্য শুধু ভবন নির্মাণের জন্য নয়, বরং এটি একটি সামাজিক পরিবর্তনের শক্তিশালী হাতিয়ার।
বাংলাদেশের স্থাপত্যের নতুন যুগ
জেবুন্নেছা মসজিদ শুধু একটি স্থাপনা নয়—এটি একটি বার্তা। এটি বাংলাদেশের স্থাপত্যে এক নতুন ধারা সূচনা করেছে, যেখানে কার্যকারিতা, টেকসইতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা একসাথে কাজ করছে।
এই প্রকল্পটি প্রমাণ করছে যে বাংলাদেশের স্থপতিরা আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম, এবং এটি নতুন স্থপতিদের সৃজনশীল হতে উদ্বুদ্ধ করবে।
আরো জানুন জেবুন্নেছা মসজিদ সম্পর্কে:
TIME Magazine-এর প্রতিবেদন: লিঙ্ক
The Daily Star প্রতিবেদন: লিঙ্ক
স্থাপত্য যখন পরিচয়ের প্রতিচ্ছবি
জেবুন্নেছা মসজিদ শুধু একটি স্থাপত্যশৈলীর অনন্য দৃষ্টান্ত নয়, এটি বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের এক শক্তিশালী প্রতীক। এটি প্রমাণ করে যে স্থাপত্য শুধুমাত্র ইট-পাথরের নির্মাণ নয়, বরং মানুষের আবেগ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, এবং সামাজিক মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ।
এই মসজিদ নতুন এক ধারার সূচনা করেছে, যেখানে স্থাপত্য কেবল নান্দনিক সৌন্দর্যের বাহন নয়, বরং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, সমতা ও পরিবেশবান্ধব নকশার মাধ্যমে মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার হাতিয়ার। এটি দেখিয়েছে যে একটি ধর্মীয় স্থাপনাও হতে পারে এমন এক আশ্রয়স্থল, যেখানে কর্মজীবী মানুষ মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পায়, যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়।
বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাওয়া এই স্থাপনা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক স্থাপত্যের মানচিত্রে নতুন করে পরিচিত করেছে। এটি আমাদের তরুণ স্থপতিদের অনুপ্রাণিত করবে নতুনভাবে চিন্তা করতে—যেখানে স্থাপত্য শুধু ভবন নয়, বরং মানবিকতা, সংস্কৃতি ও ভবিষ্যতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের এক সেতুবন্ধন।
জেবুন্নেছা মসজিদ আমাদের শিখিয়ে দিল যে, স্থাপত্যের প্রকৃত উদ্দেশ্য শুধু একটি স্থাপনা গড়ে তোলা নয়; বরং তা মানুষ ও সমাজের প্রয়োজন মেটানো, আবেগকে ধারণ করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকা। এটি কেবল একটি মসজিদ নয়, এটি এক নতুন চিন্তার প্রতিফলন—যেখানে বাংলাদেশি স্থাপত্য বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে।
এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রতিচ্ছবি, আমাদের ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।