![]()
ভেনেজুয়েলার বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির জটিলতার মধ্যেই এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন দেশটির শীর্ষ বিরোধী নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদো। কিন্তু নিজের দেশের রাজনৈতিক নিপীড়ন ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে তিনি নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিতব্য নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারছেন না। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি শুধু একটি রাজনৈতিক অনুপস্থিতিই নয়—এটি একজন গণতন্ত্র–সংগ্রামীর নিরাপত্তাহীন জীবন ও ত্যাগের এক গভীর প্রতিচ্ছবি।
নোবেল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে, মারিয়া মাচাদোর হয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করবেন তার কন্যা আনা কোরিনা মাচাদো। তিনি মায়ের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করবেন—একটি বক্তব্য, যা শুধু পুরস্কারের আনুষ্ঠানিক বাণী নয়, বরং ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের কণ্ঠস্বর।
গণতন্ত্রের পথে সংগ্রামী এক নারীর সাহস ও মূল্য
গত ১০ অক্টোবর, ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলনের স্বীকৃতিস্বরূপ মাচাদোকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান ঘোষণা করা হয়। শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, তার দৃঢ় অবস্থান তাকে বিশ্বের গণতন্ত্র-সংগ্রামীদের এক অনুপ্রেরণায় রূপ দিয়েছে।
কিন্তু এই স্বীকৃতির পথ ছিল অত্যন্ত কঠিন।
মাচাদো গত বছর আগস্টে নিপীড়নের মুখে গোপনে দেশত্যাগ করেন। সরকারের কঠোর নজরদারি এবং রাজনৈতিক হয়রানি তাকে দীর্ঘদিন অদৃশ্য থাকতে বাধ্য করে। তারপর মাত্র একবার—গত ৯ জানুয়ারি—তিনি প্রকাশ্যে নেত্রিত্ব দেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিক্ষোভে, যেখানে মাদুরোর তৃতীয় মেয়াদের শপথের বিরুদ্ধে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমেছিল।
মাদুরো সরকারের কঠোর অবস্থান: নোবেলজয়ীর বিরুদ্ধে মামলা ও হুমকি
ভেনেজুয়েলার অ্যাটর্নি জেনারেল তারেক উইলিয়াম সাব হুমকি দিয়ে বলেছেন,
“মাচাদো যদি নরওয়ে যান, তাকে পলাতক হিসেবে গণ্য করা হবে।”
তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো হলো—
-
ষড়যন্ত্র
-
ঘৃণা উসকানি
-
সন্ত্রাসবাদে ভূমিকা
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই অভিযোগগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছে। মাচাদোর অনুপস্থিতি তাই শুধু একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক বাধাগ্রস্ততা নয়; এটি একটি রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার সংকটের প্রতীক।
পরিবারের কাঁধেই দায়িত্ব: নোবেল মঞ্চে এক মানবিক মুহূর্ত
নোবেল ইনস্টিটিউটের পরিচালক ক্রিস্টিয়ান বার্গ হার্পভিকেন জানিয়েছেন—
“ইতিহাসে বহুবার নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজেতারা রাজনৈতিক বা মানবিক সংকটের কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। সে ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের সদস্যরাই পুরস্কার গ্রহণ করেন এবং বক্তব্য পাঠ করেন।”
মাচাদোর ক্ষেত্রেও সেই ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হলো।
তার কন্যা আনা কোরিনা শুধু পুরস্কার গ্রহণ করছেন না—তিনি তার মায়ের সংগ্রাম, তার দেশের মানুষের ব্যথা, আশার আলো এবং গণতন্ত্রের স্বপ্ন বহন করে অসলো মঞ্চে দাঁড়াবেন।
উল্লেখযোগ্য হলো—ইতোমধ্যে মাচাদোর পরিবারের কয়েকজন সদস্য এবং আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মাইলিসহ লাতিন আমেরিকার আরও কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধান অসলোতে পৌঁছেছেন।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে ভেনেজুয়েলার সংকট নতুনভাবে আলোচনায়
এই পুরস্কার ভেনেজুয়েলা সংকটকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনায় তুলেছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়া এবং বিরোধী দলের ওপর কঠোর দমন—এসব বিষয় আবারও বড় করে সামনে এসেছে।
এই সংকটের মানবিক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর—যারা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছেন না, ভোট দিতে ভয় পাচ্ছেন এবং বহু পরিবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
অন্যান্য নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানের আয়োজন
একই দিনে স্টকহোমে চিকিৎসা, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য ও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পৃথক অনুষ্ঠানে প্রদান করা হবে। কিন্তু মানবতার মূল্য, গণতন্ত্রের অধিকার এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম—এই সবকিছুর প্রতীক হিসেবে মাচাদোর অনুপস্থিতি এ বছরের শান্তি পুরস্কারকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
পাঠকের মন্তব্য