![]()
স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে নিয়মিত ও নিরাপদ ফেরি যোগাযোগ পাচ্ছে—যা স্থানীয় সাড়ে সাত লাখ মানুষের জীবনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে বলে আশাবাদ এলাকার মানুষজনের। বহু দশকের সংগ্রাম, আন্দোলন, দুর্ঘটনা আর দুর্ভোগের পর অবশেষে স্বপ্ন পূরণের বাস্তব দৃশ্য দেখতে শুরু করেছেন হাতিয়াবাসী।
দশকের পর দশক ধরে হাতিয়ার সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম ছিল নৌযান—পুরোনো সিট্রাক, ট্রলার ও স্পিডবোট। প্রতিকূল আবহাওয়ায় নৌচলাচল বন্ধ হয়ে যেত, নষ্ট হতো সিট্রাক, মাঝনদীতে ঝুঁকি নিয়ে ট্রলার চলতো। অনেকে জীবিকা হারিয়েছেন নৌদুর্ঘটনায়, অনেকে জরুরি সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে পরিবার হারিয়েছে প্রিয় মানুষকে।
ফেরিঘাট নির্মাণের ব্যস্ততা—স্বপ্ন যেন হাতের কাছে
বর্তমানে নলচিরা ও চেয়ারম্যান ঘাটে ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। দুই পাড়েই চলছে মাটি ভরাট, সড়ক নির্মাণ, ল্যান্ডিং স্টেশন ও র্যাম্প প্রস্তুতকরণসহ নানা কাজ। প্রতিদিন নতুন নতুন অগ্রগতি দেখে দ্বীপবাসীর চোখে ফুটে উঠছে আশার আলো।
সন্ধ্যার আগে নলচিরা ঘাটে দেখা যায় স্থানীয় ব্যবসায়ী দুলাল ব্যাপারীকে। তিনি প্রতিদিনই কাজের অগ্রগতি দেখতে আসেন। আবেগভরা কণ্ঠে বলেন,
“জীবনে ভাবিনি হাতিয়ায় ফেরি আসবে। কিন্তু এখন চোখের সামনে বাস্তব হচ্ছে। ট্রাক দোকানের সামনে গাড়ি থামাবে—এটা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো।”
চট্টগ্রাম বা চাঁদপুর থেকে ট্রলার বোঝাই করে মাল আনার সময় কতবার দুর্ঘটনার মুখে পড়তে হয়েছে তা স্মরণ করতে গিয়ে তার চোখ ভিজে ওঠে।
রোগী, শিক্ষার্থী—অসংখ্য মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখ শেষ হচ্ছে
নদীর তীরে পল্লী চিকিৎসক তানভির উদ্দিন বলেন,
“নৌযান বন্ধ থাকলে অসংখ্য মানুষ ঘাটে আটকা পড়ে। গর্ভবতী মায়েদের নিয়ে কতবার অসহায় অবস্থায় অপেক্ষা করতে হয়েছে। ফেরি চালু হলে অনেক মানুষ বেঁচে যাবে—এটা শুধু যোগাযোগ উন্নয়ন নয়, মানুষের নিরাপত্তার বিষয়।”
তিনি জানান, অনার্স ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগের দিন নৌযান বন্ধ থাকায় প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী ঘাটে কাটিয়েছিল পুরো রাত।
পণ্য পরিবহনেও আসবে বিপ্লব
হাতিয়ায় উৎপাদিত ইলিশ, ঢাল, বাদাম, ধানসহ নানান কৃষি ও মৎস্যপণ্য এতদিন ছোট নৌযানে ঝুঁকি নিয়ে আনা–নেওয়া হতো। ফেরি চালু হলে এসব পণ্য ট্রাকযোগে বড় মোকামে পাঠানো যাবে, নষ্ট হওয়া কমবে, দামও মিলবে ন্যায্য।
দীর্ঘ আন্দোলন ও প্রচেষ্টার ফল
হাতিয়া সম্মিলিত সামাজিক সংগঠনের সদস্য মো. জুয়েল জানান,
“এই ফেরি চালুর দাবিতে বহু বছর আন্দোলন করেছি। নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেছেন। আজ যে কাজ আমরা চোখে দেখছি—এটা হাতিয়াবাসীর ঐকান্তিক চেষ্টার ফল।”
নৌ–উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন কয়েক দফা এলাকা পরিদর্শনের পর প্রকল্পটি গতি পায়। স্থানীয়দের মতে, এটি শুধু একটি উন্নয়ন প্রকল্প নয়—দ্বীপের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
কর্তৃপক্ষের অগ্রগতি ও পরিকল্পনা
বিআইডব্লিউটিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ এস এম আশরাফুজ্জামান বলেন,
“লো-ওয়াটার ও মিড-ওয়াটার—মোট চারটি র্যাম্পের কাজ চলছে। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে মানিয়ে গাড়ি ওঠা-নামার উপযোগী ঘাট নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি জেটি ও যাত্রীছাউনি নির্মাণের জন্যও বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।”
তিনি আশা প্রকাশ করেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে খুব শিগগিরই ফেরি চালু সম্ভব হবে।
দ্বীপবাসীর চোখে আশার নতুন ভোর
ফেরি চালু হলে চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা, জরুরি সেবা—সব ক্ষেত্রেই হাতিয়ার মানুষ অভাবনীয় উন্নতি দেখতে পাবেন। অনেকের মতে, এই প্রকল্প হাতিয়ার বহু বছরের বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস বদলে দেবে, খুলে দেবে উন্নয়ন ও নিরাপত্তার নতুন অধ্যায়।
পাঠকের মন্তব্য