![]()
ভারতের কাস্টমস কর্তৃপক্ষের জটিলতার কারণে বেনাপোল স্থলবন্দরে প্রায় দুই মাস ধরে আটকে আছে সুপারি বোঝাই দেড় শতাধিক ট্রাক। এ পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা, আর অচলাবস্থায় রপ্তানিকারকদের প্রতিদিন প্রায় তিন লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
সীমান্তের এই দীর্ঘসূত্রতা শুধু ব্যবসায়িক ক্ষতি নয়—চালক, শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট শত শত মানুষের জীবনে তৈরি করেছে অসহনীয় মানবিক সংকট। কেউ ঠিকমতো খাবার পাচ্ছেন না, কেউ রাস্তার পাশে কাটাচ্ছেন দিন-রাত; আবার অনেকেই দেশের বাণিজ্য ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে দিন পার করছেন।
চালকদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ: “১ মাস ২৭ দিন ধরে একই জায়গায়”
বন্দর এলাকায় আটকে থাকা ট্রাকচালক আব্দুল মোমিনের কণ্ঠে যেন জমে থাকা ক্ষোভ ও ক্লান্তির প্রতিধ্বনি। তিনি বলেন—
“১ মাস ২৭ দিন ধরে এখানে আটকে আছি। প্রতিদিন নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন কাটছে। কী খাবো, কোথায় ঘুমাব—সবকিছুতেই অস্থিরতা।”
মানুষের মৌলিক প্রয়োজনগুলো যখন হুমকির মুখে, তখন ব্যবসায়িক ক্ষতির চেয়েও বড় হয়ে ওঠে মানবিক পরিস্থিতির এই চিত্র।
রপ্তানিকারকদের আর্থিক ক্ষতি: প্রতিদিন ২ হাজার টাকা করে ট্রাকপ্রতি খরচ
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স আউলিয়া এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি আশরাফুল ইসলাম জানান, পেট্রাপোল কাস্টমস মান পরীক্ষার অজুহাতে পণ্য ছাড়ে অযথা বিলম্ব করছে।
তিনি বলেন—
“কালক্ষেপণের কারণে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ছে।”
বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রতিবছর প্রায় ৭০০ কোটি টাকা মূল্যের সুপারি রপ্তানি হয়। শুধু গত বছরই ভারতের মোট আমদানির ৩৭ শতাংশ এসেছিল বাংলাদেশ থেকেই। অথচ এখন সীমান্তে বাধা, কাগজপত্রে জটিলতা ও অতিরিক্ত শর্তের কারণে রপ্তানি কার্যক্রম ঢিলেঢালা হয়ে পড়েছে।
সরকার পরিবর্তনের পর কড়াকড়ি বেড়েছে: রপ্তানি কমেছে ৩০%
ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর ভারত রপ্তানিকৃত পণ্যের ওপর বাড়তি শর্ত আরোপ করতে শুরু করে।
এর ফলে স্থলপথের রপ্তানি মোটামুটি ৩০ শতাংশ কমে এসেছে।
বিশেষত—
-
পাট ও পাটজাত পণ্য
-
তৈরি পোশাক
-
কাঠের আসবাব
-
ফলের রস
—এসব পণ্যের রপ্তানি প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
দুই দেশের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন: আমিনুল হকের সতর্কতা
বেনাপোল আমদানি–রপ্তানিকারক সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক বলেন—
“বাণিজ্যে ব্যাঘাত হলে দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সংকট নিরসনে জরুরি ভিত্তিতে দুই দেশের সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।”
তিনি আরও জানান, ভারতীয় কাস্টমসের কঠোরতা শুধু সুপারি নয়, দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাতের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ
বেনাপোল উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক আবু তালহা জানান—
২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এই বন্দর দিয়ে ১০,৬৫০ টন সুপারি রপ্তানি হয়েছে।
তিনি বলেন—
“ট্রাকগুলো আটকে থাকার বিষয়টি আমরা জানি। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাওয়া মাত্র দ্রুত ছাড়করণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) মো. শামীম হোসেনও বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, অচলাবস্থার কারণে বিশাল অঙ্কের পণ্য অযথা সীমান্তে পড়ে আছে।
বাণিজ্যিক বাধা ও মানবিক চাপ—দুটি সংকটই ক্রমশ বাড়ছে
এই দীর্ঘ ২ মাসে বাণিজ্যের চাকা শুধু থেমেই নেই—আটকে থাকা মানুষগুলোর জীবনে এসেছে ভীষণ চাপ। ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক ক্ষতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন, আর চালকেরা সীমান্তে দিন–রাত কাটাচ্ছেন অস্বাস্থ্যকর ও অনিশ্চিত পরিবেশে।
সীমান্তের এই অচলাবস্থা শুধু দুই দেশের বাণিজ্য নয়—মানুষের জীবন ও জীবিকাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে।
দ্রুত সমাধানই এখন সময়ের দাবি।
পাঠকের মন্তব্য