![]()
মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম রায়: দুইজনের মৃত্যুদণ্ড, একজনের ৫ বছরের সাজা—বিচার রায়ের সাথে সাথেই জ্বলেছে ব্যথার স্মৃতি, ক্ষোভের আগুন এবং ন্যায়ের নতুন দাবি
গত বছরের জুলাই-অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন, যিনি পরে রাষ্ট্র পক্ষের সাক্ষী হন, পেয়েছেন ৫ বছরের কারাদণ্ড।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করে। ৪৫৩ পৃষ্ঠার এই রায় ছয় ভাগে পড়া হয়। উপস্থিত ছিলেন শহিদ পরিবারের সদস্যরা—যাঁদের কান্নায়, ব্যথায় ও অপেক্ষায় আজকের দিনটি একটি দীর্ঘ ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি।
ব্যথা, রক্ত ও ন্যায়ের আহ্বান—ট্রাইব্যুনাল চত্বরের মানবিক দৃশ্য
রায় ঘোষণার সময় অনেককেই দেখা গেছে চোখে অশ্রু নিয়ে।
নিহত সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মা সামছি আরা জামান—তাঁর দু’চোখের কান্না যেন এই বিচার যাত্রার দীর্ঘ পথ চলার প্রতীক।
মীর মুগ্ধর ভাই মীর স্নিগ্ধ, রংপুরের নিহত ছাত্র আবু সাঈদের পরিবার, চানখাঁরপুলের নিহতদের স্বজন—প্রত্যেকেই বলছিলেন,
“আজ শুধু রায় নয়, আজ বিচারহীনতার বিরুদ্ধে এক নতুন সূর্যোদয়।”
গণঅভ্যুত্থানে নিহত দুই হাজার মানুষ ও আহতদের পরিবারের কাছে এই রায় শুধুই আইনি সিদ্ধান্ত নয়—একটি মানবিক স্বীকৃতি, একটি অশ্রুসিক্ত জয়।
অভিযোগগুলোর মানবিক দিক: পরিবারগুলো কী হারিয়েছে?
১. উসকানিমূলক ভাষণ—যা পরিণত হয় হত্যায়, নিখোঁজে, আগুনে
গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া উসকানিমূলক বক্তব্যের পরদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বহু তরুণ নিহত ও নিখোঁজ হয়।
তাদের মায়ের আর্তনাদ আজও থামেনি।
২. হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর নির্দেশ—শিশু ও সাধারণ মানুষ নিহত
হেলিকপ্টার থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশে প্রাণ হারায় সাধারণ ছাত্র, পথচারী, এমনকি কিশোরও।
এদের পরিবার আজও জানে না—কেন?
৩. রংপুরে ছাত্র আবু সাঈদ হত্যা—দেশকে কাঁদানো গল্প
দুই চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন রংপুরের আবু সাঈদ।
তার মায়ের একটি কথাই যেন পুরো পরিস্থিতির মানবিক সারাংশ:
“আমি রাজনীতি বুঝি না, শুধু আমার ছেলেটাকে চাই।”
৪. চানখাঁরপুল হত্যা—গুম হওয়া লাশ, ভাঙা পরিবার
চানখাঁরপুলে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের আজও কেউ সঠিক সংখ্যা বলতে পারে না।
কারও লাশ মেলেনি, কারও নাম নেই কোনো নথিতে।
৫. আশুলিয়ায় হত্যা ও লাশ পোড়ানো—যন্ত্রণার শেষ বিন্দুতেও ন্যায়বিচার দাবি
আশুলিয়ায় হত্যা-পরবর্তী লাশ পোড়ানোর অভিযোগ পরিবারগুলোর বুকে আজও আগুন হয়ে জ্বলছে।
তারা আজ বলে—”আমরা অন্তত সত্যটা জানতে পেরেছি।”
রায়ের মুহূর্ত লাইভ—টিএসসিতে মানবীয় আবেগের বিস্ফোরণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বড় পর্দায় রায় দেখছিলেন হাজারো মানুষ।
ছাত্র-ছাত্রীদের স্লোগান, চোখ ভরা কান্না, দীর্ঘদিনের ব্যথার প্রকাশ—সবই মানবিক শক্তির প্রতিচ্ছবি।
‘দুই হাজার শহীদ, শহীদ পরিবারের ন্যায়বিচার চাই’
‘ফাঁসি চাই, হাসিনার ফাঁসি চাই’
—এগুলো শুধু স্লোগান নয়, বরং ঘটনার শিকার পরিবারের মরিয়া আহ্বান।
ধানমন্ডি ৩২—এক্সকাভেটর, উত্তেজনা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া
রায় ঘোষণার সময় ধানমন্ডি ৩২-এর সামনে বিক্ষোভকারীদের হাতে এক্সকাভেটর দেখা যায়—যা পরিস্থিতির গভীর উত্তেজনা ও জনরোষের মাত্রা প্রকাশ করে।
পুলিশ-সেনাবাহিনী তাদের ঠেকায়; সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়া হয়; ইটের আঘাতে আহত হন অনেকে।
এই উত্তেজনার মূল কারণ—শহিদদের পরিবারের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, যন্ত্রণার ইতিহাস, এবং তাদের মতে “ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রতীক ধানমন্ডি ৩২” ভেঙে ফেলার প্রতীকী বার্তা।
রাষ্ট্রবিরোধী সহিংসতার ঝুঁকি এবং নিরাপত্তা জোরদার
শনিবার রাত থেকেই দেশজুড়ে যেসব যানবাহন পোড়ানো, বিস্ফোরণ হয়েছে—এসবই রায়ের প্রেক্ষিতে উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ।
পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী ও বিজিবি ট্রাইব্যুনাল ঘিরে আয়রণ ওয়ালের মতো নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর ভাষায়,
“যেকোনো বিশৃঙ্খলার মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত।”
নতুন বাংলাদেশের সামনে দাঁড়ানো প্রশ্ন—এখন শুরু কি ন্যায়বিচারের নতুন যুগ?
এই রায় কেবল তিনজনের শাস্তি নয়—এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক নতুন অধ্যায়।
কিন্তু প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে:
-
এখন কি সত্যিই শেষ হলো দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি?
-
গণঅভ্যুত্থানের সব ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কি হবে?
-
শহিদ পরিবারের ক্ষত কি সত্যিই সারবে?
-
ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ আরও কত পরিবার আছে?
এই রায়—একদিকে ন্যায়বিচারের জয়ের মুহূর্ত, অন্যদিকে মানবিক বেদনার চিরস্থায়ী দলিল।
শেষ কথা: বিচার শেষ নয়—মানবিক ক্ষত সারানোর যাত্রা এখন শুরু
বাংলাদেশের হাজারো মানুষ, বিশেষ করে নিহতদের পরিবার, দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করেছে এই রায়ের জন্য।
তাদের চোখের জল, তাদের নীরবতা, তাদের হারানো সন্তানদের স্মৃতি—সব মিলিয়ে আজকের দিনটি শুধু রাজনৈতিক নয়, মানবিক ইতিহাসের অংশ।
আজকের রায়—
ন্যায়ের পথে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলেও এগিয়ে চলা।
পাঠকের মন্তব্য