![]()
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার খান ইউনিসের বানি সুহেলায় আবারও বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। হামাসের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি চলমান থাকলেও বাস্তবে গাজায় শান্তি নেই—রাতভর গর্জে উঠেছে যুদ্ধবিমান, কেঁপে উঠেছে শরণার্থী শিবিরের তাঁবুগুলো। নিহত হয়েছে অন্তত তিন ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন অনেকে।
বানি সুহেলার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, যে স্থানে হামলা চালানো হয়েছে তা ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণাধীন ‘হলুদ রেখা’র বাইরে ছিল। “আমরা ভেবেছিলাম যুদ্ধবিরতি আমাদের একটু নিঃশ্বাস নিতে দেবে,” বলেন স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হামিদ, “কিন্তু আজ আবার আমাদের তাঁবুগুলোই লক্ষ্যবস্তু।”
যুদ্ধবিরতির নামে মৃত্যুর পরিসংখ্যান
আলজাজিরার তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতির পর থেকে এখন পর্যন্ত ২৪১ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন ইসরায়েলি হামলায়। অর্থাৎ যুদ্ধ থেমে গেলেও মৃত্যু থামেনি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মোট ৬৯ হাজার ১৬৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে প্রতিদিনই উদ্ধার হচ্ছে নতুন নতুন মরদেহ, যাদের অনেকের পরিচয় জানা সম্ভব হচ্ছে না।
চিকিৎসা কর্মকর্তারা জানান, শনিবার বুরেজি শরণার্থী শিবিরে এক ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন। এছাড়া গাজার উত্তর ও দক্ষিণ অংশে ‘হলুদ রেখা’ অতিক্রমের অভিযোগে আরো দুজনকে গুলি করে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
‘হলুদ রেখা’র ভয় এবং আশঙ্কার বাস্তবতা
ইসরায়েল গাজার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের মাঝে তথাকথিত এক “হলুদ রেখা” চিহ্নিত করেছে, যা তাদের নিয়ন্ত্রণ এলাকার সীমা নির্দেশ করে। ফিলিস্তিনিরা বলছেন, এ রেখার ভেতর বা বাইরে থাকা—কোনোটাই এখন নিরাপদ নয়।
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও এই রেখার আশপাশে প্রতিদিনই হামলা, গোলাবর্ষণ বা গুলিবর্ষণের খবর আসছে।
“আমরা প্রতিদিন আতঙ্কে ঘুমাতে যাই,” বলেন খান ইউনিসের বাসিন্দা নূর আহমেদ। “কখন আকাশ ফেটে আগুন নামবে জানি না। আমাদের বাচ্চারা শব্দ শুনলেই কাঁদতে শুরু করে।”
মানবিক বিপর্যয়ের সীমা ছাড়িয়েছে গাজা
দুই বছর পেরিয়ে গেলেও গাজার অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, এই যুদ্ধ ও অবরোধের ফলে গাজার ৮০ শতাংশ মানুষ এখন মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। খাদ্য, পানি, চিকিৎসা—সব কিছুরই ঘাটতি চরম পর্যায়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, গাজার অর্ধেকেরও বেশি হাসপাতাল বন্ধ বা অচল অবস্থায় রয়েছে। চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ, বিদ্যুৎ—সব কিছুরই সংকট।
এমন প্রেক্ষাপটে, যখন যুদ্ধবিরতির নামে শান্তির আশা জাগানো হয়েছিল, তখন নতুন করে হামলা গাজার মানুষকে আরও ভয় ও অনিশ্চয়তার গভীরে ঠেলে দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক নীরবতা ও মানবতার প্রশ্ন
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, চলমান যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ইসরায়েলি হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবতার চরম লঙ্ঘন। যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের পরও বিশ্ব শক্তিগুলোর নীরবতা গাজাবাসীর জন্য এক নতুন হতাশা।
“আমরা বারবার বলেছি—এটি শুধু যুদ্ধ নয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ,” বলেন গাজার স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রধান লায়লা নাসের।
তিনি আরও বলেন, “প্রতিটি হামলার পর ধ্বংসস্তূপে আমরা শুধু মৃতদেহ পাই, কোনো ন্যায়বিচার পাই না।”
গাজার ভবিষ্যৎ: এক অশেষ অনিশ্চয়তা
গাজা এখন এক খোলা আকাশের নিচে বন্দিশিবির। সেখানকার শিশুরা জানে না আগামী সকাল তারা বাঁচবে কিনা। যুদ্ধবিরতির নামে চলা এই মৃত্যুযজ্ঞ গাজাবাসীর জীবনে শুধু ভয়ের, ক্ষুধার, আর শোকের নতুন অধ্যায় যোগ করছে।
বানি সুহেলার ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে এক মা বলেন,
“আমরা শান্তি চাই না, আমরা কেবল এক রাত শান্তিতে ঘুমাতে চাই।”
পাঠকের মন্তব্য