পুকুরপাড়ের ছায়াঘেরা চত্বর। মাঝখানে বৃত্তাকার পাকা দেয়ালঘেরা এক বেদি—যেখানে লাল-সবুজের প্রতীক সূর্যের নিচে অমর শহীদদের স্মৃতি। সেটিই ছিল সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার।
প্রায় ৬০ বছর ধরে কলেজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিক্ষার্থীদের আবেগের অংশ এই স্থাপনাটি এখন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি স্মারকস্তম্ভ—যা নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন কলেজের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা।
শহীদ মিনার ভাঙা ও নতুন স্থাপনা নির্মাণ
কলেজ ক্যাম্পাসে ভাষা শহীদদের স্মরণে ১৯৬৬ সালে শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে এটি ধ্বংস করে পাকিস্তানি সেনারা। স্বাধীনতার পর ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে তা পুনর্নির্মাণ করা হয়।
তবে সম্প্রতি কলেজের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ‘সুনাম ফলক’ নামের একটি স্মারকস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কাজ শুরু হয় প্রায় এক মাস আগে।
এ বিষয়ে জানাজানির পর থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
কলেজ ছাত্রদলের পক্ষ থেকে গতকাল মঙ্গলবার অধ্যক্ষের কাছে নির্মাণকাজ বন্ধ ও শহীদ মিনার পুনঃস্থাপনের দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। আজ বুধবার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আয়োজনে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে।
পাল্টাপাল্টি দায়: কলেজ কর্তৃপক্ষ বনাম শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর
শহীদ মিনার ভাঙার ঘটনায় কলেজ কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর পরস্পরের ওপর দায় চাপাচ্ছে।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সুনামগঞ্জ নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান বলেন,
“কলেজ কর্তৃপক্ষই আমাদের স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমাদের প্রস্তাব ছিল প্রধান ফটকের পাশে উত্তর দিকে স্থাপন করার, কিন্তু তারা রাজি হয়নি। এখন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।”
অন্যদিকে কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন,
“এটি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজ, তারাই স্থান নির্ধারণ করেছে। তবে পরে দেখা যাচ্ছে, আসলে আমরা বলেছিলাম, এখানে কাজ করা যাবে কি না। তারা রাজি হওয়ায় কাজ হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এখন নতুন করে আলোচনা করব।”
প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ১৯৭৩–৭৪ সালের সহসভাপতি (ভিপি) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
“এটি শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি আমাদের ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের অংশ। ১৯৬৬ সালে এই শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়—এটি জেলায় প্রথম শহীদ মিনার ছিল। আমরা এই চত্বরে সভা–সমাবেশ করতাম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতাম। এখন সেটি ভেঙে স্মারকস্তম্ভ নির্মাণ করা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
তিনি বলেন, “কলেজে পর্যাপ্ত জায়গা থাকা সত্ত্বেও কেন শহীদ মিনার ভেঙে সেখানে স্মারক নির্মাণ করতে হলো, তা বোধগম্য নয়।”
‘সুনাম ফলক’ প্রকল্পের পটভূমি
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৪ সালে; সরকারীকরণ হয় ১৯৮০ সালে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলেজের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনীতে স্মৃতি ধরে রাখতে স্মারকস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী,
স্মারকটির নকশা করেছেন ভাস্কর হামিদুজ্জামান।
এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা।
এ প্রকল্পের আওতায় আরও দুটি স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে—
সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ের ১২৫ বছর পূর্তি এবং সতীশচন্দ্র বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের স্মারক।
বর্তমান অবস্থা ও প্রশাসনিক উদ্যোগ
শহীদ মিনার ভাঙার ঘটনাটি নিয়ে এখন কলেজ ক্যাম্পাসে তীব্র বিতর্ক চলছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া জানিয়েছেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং আপাতত নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
উপসংহার
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের শহীদ মিনার শুধু একটি স্থাপনা নয়—এটি জেলার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহক এক ঐতিহাসিক নিদর্শন।
এই মিনার ভেঙে নতুন স্মারক নির্মাণের সিদ্ধান্ত ইতিহাস–ঐতিহ্যের প্রতি অবমাননা কিনা, তা এখন পুরো সুনামগঞ্জজুড়ে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাঠকের মন্তব্য