ইতালির রোমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদর দপ্তরে আয়োজিত বিশ্ব খাদ্য ফোরাম (WFF) ২০২৫-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আহ্বান জানিয়েছেন— “ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়তে আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই বদলাতে হবে।”
তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন,
“ক্ষুধা কোনো অভাবের কারণে নয়, এটি আমাদের তৈরি করা অর্থনৈতিক কাঠামোর ব্যর্থতা।”
ছয় দফা প্রস্তাব: নতুন মানবিক অর্থনীতির রূপরেখা
১️যুদ্ধ বন্ধ ও সংলাপ শুরু:
সংঘাতের কারণে খাদ্য বঞ্চিত মানুষদের কাছে খাদ্য পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে।
“যুদ্ধ নয়, সংলাপ—এই হোক ক্ষুধা মুক্তির প্রথম ধাপ।”
২️এসডিজি অঙ্গীকার পূরণ ও জলবায়ু পদক্ষেপ:
অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
৩️আঞ্চলিক খাদ্য ব্যাংক গঠন:
খাদ্য সরবরাহ চেইন স্থিতিশীল রাখতে আঞ্চলিক সহযোগিতায় খাদ্য ব্যাংক তৈরি জরুরি।
৪️তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা সহায়তা:
অর্থায়ন, অবকাঠামো ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে তরুণ কৃষক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ক্ষমতায়ন করতে হবে।
৫️রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার:
খাদ্য বাণিজ্যে বাধা নয়, বরং সহায়ক নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
৬️প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে ন্যায্য প্রবেশাধিকার:
বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের তরুণ উদ্যোক্তা ও কৃষকদের জন্য প্রযুক্তিগত সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
“এটি উৎপাদনের নয়, নৈতিক ব্যর্থতা”
অধ্যাপক ইউনূস বলেন,
“২০২৪ সালে ৬৭৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল, অথচ আমরা যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন করেছি।
এটি উৎপাদনের নয়, অর্থনৈতিক ও নৈতিক ব্যর্থতা।”
তিনি সমালোচনার সুরে যোগ করেন,
“ক্ষুধা দূর করতে যেখানে কয়েক বিলিয়ন ডলার জোগাড় করা যায়নি,
সেখানে অস্ত্র কিনতে বিশ্ব ব্যয় করেছে ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার—একে কি আমরা অগ্রগতি বলব?”
“মুনাফাভিত্তিক নয়, সামাজিক ব্যবসা ভিত্তিক বিশ্ব চাই”
অধ্যাপক ইউনূস বলেন,
“পুরোনো মুনাফাভিত্তিক অর্থনীতি কোটি মানুষকে পিছনে ফেলেছে।
এখন দরকার সামাজিক ব্যবসা—যেখানে লক্ষ্য হবে সমাজের সমস্যা সমাধান, ব্যক্তিগত লাভ নয়।”
তিনি তাঁর ‘তিন-শূন্য বিশ্ব’—শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য কার্বন নিঃসরণ–এর ধারণা তুলে ধরে বলেন,
“এটি কোনো স্বপ্ন নয়, এটি অপরিহার্য। এটাই টিকে থাকার একমাত্র পথ।”
বাংলাদেশের সাফল্য: “আমরা ক্ষুধাকে হারিয়েছি, আশাকে নয়”
প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন,
“বাংলাদেশ আজ ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করছে,
এবং মিয়ানমার থেকে আসা ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় ও খাদ্য দিচ্ছে।”
তিনি যোগ করেন,
“আমরা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ,
১৩৩ প্রজাতির জলবায়ু সহনশীল ধান উদ্ভাবন করেছি,
কৃষিকে সবুজ ও টেকসই করার পথে এগোচ্ছি।”
তরুণ ও নারী উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান
“তরুণদের বলবেন না চাকরি খুঁজতে—বলুন, চাকরি সৃষ্টি করতে,”
বলেছেন অধ্যাপক ইউনূস।
তিনি প্রস্তাব দেন, তরুণদের জন্য সামাজিক ব্যবসা তহবিল ও কৃষি উদ্ভাবন কেন্দ্র গঠন করতে,
যেখানে তারা প্রযুক্তি, বিনিয়োগ ও প্রশিক্ষণ পাবে।
“তিন-শূন্য বিশ্ব গড়ার যাত্রা শুরু হোক একসঙ্গে”
তিনি বলেন,
“বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
আমরা এফএও ও জি-২০-এর সঙ্গে প্রযুক্তিগত, আর্থিক ও নৈতিক সহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
শেষে তিনি আহ্বান জানান—
“আসুন, একসঙ্গে কাজ করি একটি তিন-শূন্য বিশ্ব গড়তে।”
পাঠকের মন্তব্য