বাংলাদেশের কৃষি, নারী ও তরুণ উদ্যোক্তা খাতকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একটি যুগান্তকারী প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলকে (আইএফএডি) আহ্বান জানিয়েছেন একটি “সামাজিক ব্যবসা তহবিল” গঠনের, যা দেশের তরুণ কৃষি–উদ্যোক্তা, নারী, কৃষক ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারীদের সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এই প্রস্তাবটি দেওয়া হয় ইতালির রোমে আয়োজিত বিশ্ব খাদ্য ফোরামের পার্শ্ববৈঠকে, যেখানে রোববার (১২ অক্টোবর) অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন আইএফএডি প্রেসিডেন্ট আলভারো লারিও।
সোমবার (১৩ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সামাজিক ব্যবসার নতুন দিগন্ত
বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বলেন,
“আমি আপনাদের একটি সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠনের আহ্বান জানাচ্ছি। এই তহবিল দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা, তরুণ উদ্যোক্তা, কৃষক, নারী ও মৎস্য খাতের কর্মীদের জন্য নতুন উদ্যোগ সৃষ্টি এবং সামাজিক সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারবে।”
এই উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিভিত্তিক উদ্যোক্তা কার্যক্রমে নতুন গতি আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আলোচনায় কৃষি, রপ্তানি ও প্রযুক্তি
বৈঠকে দুই নেতা বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের নানা সম্ভাবনা নিয়ে গভীর আলোচনা করেন।
এর মধ্যে ছিল:
-
বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ শিল্পের উন্নয়ন
-
আম ও কাঁঠালের রপ্তানি বাড়ানো
-
জলবায়ু-সহনশীল কৃষি–উদ্যোক্তা তৈরি
-
মহিষের দুধ থেকে মোজারেলা চিজসহ অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনে সহায়তা
প্রধান উপদেষ্টা আরও জানান,
“আমরা আম রপ্তানি শুরু করেছি, তবে পরিমাণ এখনও কম। চীন বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে আম ও কাঁঠাল আমদানিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এজন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, হিমাগার ও রপ্তানি অবকাঠামোতে বিনিয়োগ দরকার।”
আইএফএডির আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতি
আইএফএডি প্রেসিডেন্ট আলভারো লারিও বলেন,
“আইএফএডি বাংলাদেশের সঙ্গে সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগে অংশীদার হতে আগ্রহী এবং বেসরকারি খাতের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে চায়।”
তিনি জানান, বর্তমানে সংস্থাটি বাংলাদেশে ছয়টিরও বেশি কৃষি প্রকল্পে অর্থায়ন করছে, যার মধ্যে রয়েছে টেকসই কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও গ্রামীণ উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচি।
গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণে সম্ভাবনা
প্রধান উপদেষ্টা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার অব্যবহৃত সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরেন।
“আমরা এখনো গভীর সমুদ্র মৎস্য আহরণে যেতে সাহস পাই না। আইএফএডি অর্থায়ন ও প্রযুক্তি সহায়তার মাধ্যমে এই খাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জেলেরা এখনো অগভীর পানিতেই মাছ ধরেন; আধুনিক প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও বিনিয়োগ পেলে গভীর সমুদ্রেও সমৃদ্ধ মৎস্য সম্পদ আহরণ সম্ভব।
বাংলাদেশের সঙ্গে আইএফএডির অংশীদারত্ব
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে আইএফএডি ৩৭টি প্রকল্পে অংশীদার হয়েছে।
এর মোট মূল্য ৪.২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে ১.১৩ বিলিয়ন ডলার সরাসরি আইএফএডি অর্থায়িত।
বর্তমানে দেশে ৪১২ মিলিয়ন ডলারের ছয়টি প্রকল্প চলছে, আরও একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায়।
উপস্থিত ছিলেন
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন—
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার,
এসডিজি সমন্বয়কারী ও সিনিয়র সচিব লামিয়া মোর্শেদ,
পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম,
আইএফএডির সহযোগী সহ-সভাপতি ডোনাল ব্রাউন,
এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
ফরিদা আখতার বৈঠকে জানান, কীভাবে বাংলাদেশের দুগ্ধ খামারিরা ইতিমধ্যে মহিষের দুধ থেকে মোজারেলা চিজ উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন এবং এ খাতে আইএফএডির সহায়তা কামনা করেন।
মানবিক বার্তা
অধ্যাপক ইউনূসের এই প্রস্তাব কেবল একটি অর্থনৈতিক ধারণা নয়, বরং গ্রামীণ মানুষের আত্মনির্ভরতা ও মর্যাদার প্রতি এক গভীর মানবিক প্রতিশ্রুতি।
যেখানে একজন নারী কৃষক, এক তরুণ উদ্যোক্তা কিংবা এক জেলে নিজের শ্রম ও উদ্ভাবন দিয়ে নিজের ভাগ্য গড়তে পারবেন— সেখানেই সামাজিক ব্যবসার আসল শক্তি নিহিত।
পাঠকের মন্তব্য