ভারতের লাদাখের শান্ত পাহাড়ে এখন শোক ও ক্ষোভের ছায়া।
যে মানুষ একদিন “থ্রি ইডিয়টস”-এর অনুপ্রেরণা হয়ে লক্ষ তরুণের চোখে স্বপ্ন বুনেছিলেন, আজ সেই সোনম ওয়াংচুক বন্দি রাজস্থানের যোধপুর জেলে। অভিযোগ—রাষ্ট্রবিরোধিতা ও সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র।
আরও অবাক করা বিষয়—এই একই সরকার একসময় তাঁকে “জাতীয় গৌরব” হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
লাদাখের উত্থান ও ওয়াংচুকের যাত্রা
১৯৬৬ সালে জন্ম নেওয়া ওয়াংচুক ছিলেন লাদাখের উলেতকপোর সন্তান। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা ও প্রকৃতির প্রতি অনুরাগী এই মানুষটি ১৯৮৮ সালে “স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ (SECMOL)” প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর হাত ধরে লাদাখের শিক্ষাব্যবস্থায় ঘটে এক বিপ্লব।
৯৫ শতাংশ অকৃতকার্য থেকে অঞ্চলটির শিক্ষার্থীরা হয়ে ওঠে সাফল্যের প্রতীক।
২০১৩ সালে তাঁর আরেক বিস্ময়কর উদ্ভাবন—“আইস স্তূপা”। এই কৃত্রিম হিমবাহ লাদাখের কৃষকদের পানির অভাব মেটায়।
২০১৮ সালে এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পান ম্যাগসাইসাই পুরস্কার।
স্বপ্ন থেকে শৃঙ্খল
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট, যখন নরেন্দ্র মোদির সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে,
তখন ওয়াংচুক টুইটে লিখেছিলেন—
“লাদাখের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।”
কিন্তু ছয় বছর পর সেই সরকারই তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়েছে।
লাদাখের মানুষ এখন বঞ্চিত নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার থেকে। জম্মু ও কাশ্মীরের মতো আলাদা আইনসভা নেই তাদের।
এই বঞ্চনা থেকেই শুরু হয় আন্দোলন—নেতৃত্বে সোনম ওয়াংচুক।
“টাইম বোমা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে”
গত সেপ্টেম্বর লাদাখের রাজধানী লেহ শহরে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে তরুণেরা। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান চারজন, আহত বহু।
২৬ সেপ্টেম্বর ওয়াংচুককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, এখন তিনি বন্দি যোধপুর সেন্ট্রাল জেলে।
তাঁর স্ত্রী গীতাঞ্জলি আংমো আল–জাজিরাকে বলেন,
“যে সরকার তাঁকে সম্মানে ভূষিত করেছিল, আজ সেই সরকারই তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলছে।
কারণ, তাঁকে তারা অর্থ দিয়ে কিনতে পারেনি।”
তিনি আরও বলেন,
“সরকার লাদাখে টাইম বোমা বসিয়ে দিয়েছে। যেমনটা কাশ্মীরে ঘটেছিল।”
প্রশাসনের পাল্টা অভিযোগ
লাদাখ প্রশাসনের দাবি, ওয়াংচুক নাকি সরকার উৎখাতের হুমকি দিয়েছিলেন এবং বিক্ষোভে উসকানি দিয়েছেন।
তাঁর বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা আইন (NSA) প্রয়োগ করা হয়েছে,
যার অধীনে বিচার ছাড়াই এক বছর পর্যন্ত আটক রাখা যায়।
লাদাখ পুলিশের প্রধান এসডি সিং জামওয়াল দাবি করেন—
“বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ওয়াংচুকের সঙ্গে পাকিস্তানের যোগাযোগ ছিল।”
কিন্তু ওয়াংচুকের পরিবার ও সহকর্মীরা একে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলছেন।
শিক্ষা থেকে রাজনীতি—এক অবধারিত পথ
লাদাখের কারগিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের নেতা সাজাদ কারগিলি বলেন,
“একজন মানুষ রাজনীতি এড়িয়ে যেতে পারেন, কিন্তু রাজনীতি তাঁকে ছেড়ে যায় না।
আজ আমরা তাঁর পাশে—কারণ আমরা আমাদের অধিকার ফিরিয়ে পেতে লড়ছি।”
তিনি সতর্ক করে দেন—
“লাদাখ সীমান্তবর্তী সংবেদনশীল অঞ্চল। জনগণের সমর্থন হারিয়ে ফেলা ভারতের জন্য বিপজ্জনক।”
বিচারপথে স্ত্রীর লড়াই
গীতাঞ্জলি আংমো এখন স্বামীর মুক্তির দাবিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে হেবিয়াস কর্পাস মামলা করেছেন।
তাঁর অভিযোগ—গ্রেপ্তারের কারণ তাঁকে জানানো হয়নি,
এমনকি স্বামীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতিও দেওয়া হয়নি।
বিচারপতি অরবিন্দ কুমার ও এনভি আনজারিয়ার বেঞ্চ কেন্দ্রীয় সরকার ও লাদাখ প্রশাসনকে নোটিশ দিয়েছে।
আগামী ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত ওয়াংচুককে কারাবন্দীই থাকতে হবে।
গীতাঞ্জলির কণ্ঠে কেবল একটাই আহ্বান—
“সত্য বলার জন্য মানুষকে ভয় দেখানো হচ্ছে। এটি আর গণতন্ত্র নয়।”
উপসংহার
আজ লাদাখে শীত নেমেছে আগেভাগেই। কিন্তু পাহাড়ের হিমেল বাতাসের চেয়ে অনেক ঠান্ডা এখন মানুষের মনের ভেতর।
শিক্ষা ও পরিবেশের আলো জ্বালানো মানুষটিই আজ অন্ধকার কারাগারে।
আর ভারত জুড়ে প্রতিধ্বনি উঠছে—
“র্যাঞ্চোকে ফিরিয়ে দাও।”
পাঠকের মন্তব্য