পাকিস্তানে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-র হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হওয়ার খবর সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিষয়টি শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অংশ নয়, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও মানবিক ভবিষ্যতের জন্য নতুন প্রশ্ন তৈরি করছে।
টিটিপি: শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে আঞ্চলিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক
“তেহরিক” মানে আন্দোলন, “তালেবান” অর্থ শিক্ষার্থী। একসময় সীমান্তের মাদ্রাসাভিত্তিক এই সংগঠন এখন কেবল পাকিস্তান বা আফগানিস্তানেই সীমাবদ্ধ নেই। দীর্ঘ যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক জোট ও নানা রাষ্ট্রীয় কৌশলের মধ্যে দিয়ে তারা ধীরে ধীরে এক আঞ্চলিক শক্তি ও আদর্শবাদী নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে।
১৯৯৬ সালে কাবুল দখলের পর তালেবানরা উৎখাত হয়, পরে ২০২১ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরে। এই প্রেক্ষাপটেই পাকিস্তানের ভেতরে টিটিপির তৃতীয় তরঙ্গ শুরু হয়। বর্তমানে অন্তত ১৫টি সশস্ত্র গ্রুপ তাদের সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে চীন, উজবেকিস্তান, এমনকি বাংলাদেশি যোদ্ধাদের উপস্থিতির তথ্যও এসেছে।
পশতুনিস্তানের অদৃশ্য স্বপ্ন
পশতুন জনগোষ্ঠী আফগানিস্তান ও পাকিস্তানজুড়ে ছড়িয়ে আছে। তাদের পুরোনো কল্পনা একতাবদ্ধ “পশতুনিস্তান”। ডুরান্ট লাইনের বিভাজন তাদের মধ্যে ক্ষোভ রেখে গেছে। এ ক্ষোভই আজ তালেবান মতাদর্শের উর্বর মাটি তৈরি করেছে। ফলে রাষ্ট্রীয় সীমানা মেনে না চলা এক আদর্শিক ভূগোল গড়ে উঠছে, যা প্রতিবেশী সব রাষ্ট্রের জন্য হুমকি।
বাংলাদেশি সংযোগ: উদ্বেগ বাড়াচ্ছে নতুন অধ্যায়
ইতিহাসে বাঙালি ও পশতুনদের সম্পর্ক ছিল প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির মৈত্রীর ভিত্তিতে—মাওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সময় থেকে। কিন্তু আজ সেই সম্পর্কের জায়গা নিয়েছে ভিন্ন বাস্তবতা।
সম্প্রতি মাদারীপুরের এক তরুণ ফয়সালের মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসার পর বিষয়টি আড়াল রাখা আর সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানের সাংবাদিকরা আগে থেকেই টিটিপিতে বাংলাদেশি যোদ্ধাদের উপস্থিতির কথা বলছিলেন। এখন নিশ্চিত হচ্ছে, বাংলাদেশি তরুণরা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে যুক্ত হচ্ছেন এবং নিহত হচ্ছেন।
এ প্রশ্ন এখন জোরালো হচ্ছে—কে বা কারা তাদের রিক্রুট করছে, কীভাবে তারা সীমান্ত পেরোচ্ছে এবং বাংলাদেশে ফেরত এলে তাদের অবস্থান কী হবে?
পাকিস্তানের ভেতর যুদ্ধ ও মানবিক সংকট
পাকিস্তান সেনারা বর্তমানে খাইবার পাখতুনখাওয়ায় “অপারেশন সর্বাকফ” চালাচ্ছে। কিন্তু এ লড়াই মূলত নিজ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেনা ও সাধারণ পশতুনরা একই জাতিসত্তার মানুষ। এই পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রাণহানি ব্যাপক, আর তার ফলে সাধারণ মানুষ ক্রমশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক টানাপোড়েন
-
আফগানিস্তান বলে, টিটিপি সম্পূর্ণ পাকিস্তানভিত্তিক, কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই।
-
পাকিস্তান বলে, টিটিপি আফগানিস্তান থেকেই শক্তি, জনবল ও অস্ত্র পাচ্ছে।
-
ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন—সবার ভূরাজনৈতিক স্বার্থ জড়িয়ে আছে এই সংঘাতে।
-
আর এদিকে বাংলাদেশি তরুণদের মৃত্যু বা সম্পৃক্ততা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাকে আরও জটিল করে তুলছে।
মানবিক দৃষ্টিকোণ
এই সংঘাতে কেবল যোদ্ধারাই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন হাজারো নিরীহ মানুষ। পাকিস্তানের সীমান্ত গ্রামে স্কুল বন্ধ, হাসপাতাল ভেঙে পড়া অবস্থায়। বাস্তুচ্যুত হচ্ছে পশতুন পরিবারগুলো। এই বাস্তবতায় যখন বাংলাদেশ থেকে কেউ টিটিপিতে যোগ দিচ্ছে, তখন বিষয়টি শুধু নিরাপত্তা নয়, মানবিক সংকটেরও প্রতিফলন।
পাঠকের মন্তব্য