গাজার গভীরতম সংকট আজ নতুন মাত্রা পেয়েছে—স্থানীয় হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী বুধবার রাতভর ও পরের ভোর পর্যন্ত অন্তত ৮০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন; হতাহতদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক নারী ও শিশু রয়েছেন। ফাইরাস মার্কেটের কাছে বাস্তুচ্যুত পরিবারের আশ্রয়ে অগ্রসর এক হামলায় একটি ভবন ও তাঁবুতে রাতভর সংঘটিত বিস্ফোরণে একত্রে অন্তত ২০ জন নিহত হওয়ার খবরে এলাকাটির সরাসরি কষ্ট ও ধ্বংসলীলার চিত্র উঠে আসে। গাজার স্বাস্থ্য ও মানবিক অবকাঠামো ইতিমধ্যে ভেঙ্গে পড়েছে—অক্সিজেন প্ল্যান্টগুলো ক্ষতিগ্রস্ত, হাসপাতালের সেবাসুবিধা সীমিত ও নির্যাতিত নাগরিকরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে তাড়িত।
ঘটনার বর্ণনা ও প্রত্যক্ষদর্শীর কণ্ঠ
ফাইরাস মার্কেট সংলগ্ন সেই স্থানটি বর্তমানে বাস্তুচ্যুত বহু পরিবারের আশ্রয়কেন্দ্র ছিল—ওই দলে ছোট-বড় সবাই এক পাততলায়, তাঁবুতে বা অস্থায়ী শেল্টারে ঘুমাতেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, “রাতে হঠাৎ করে ব্যাপক বিস্ফোরণ—মানুষ ঘুমে ছিল।” এক আত্মীয়, যিনি পরে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন, এএফপিকে বলেছেন, “আমরা এসে দেখি নারীদের ও শিশুদের ছিন্নভিন্ন অবস্থা; এটি একটি করুণ দৃশ্য।” ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে মরদেহ তুলে নেয়ার ভিডিওতে শিশুদের কবরের মতো কভারের ভেতরে রাখা দেহ ও ছিন্নমর্ম কণ্ঠের কান্না দেখা গেছে—যা দেখেছে এমন প্রত্যেকের মনে গভীর ট্রমা রেখে যাবে।
হাসপাতালের পরিস্থিতি ও আরোগ্য সেবার ধ্বস
গাজার হাসপাতালগুলো বুধবার বিকেলে রিপোর্ট দিয়েছে—মধ্যরাত থেকে তারা ৬০ জনেরও বেশি মরদেহ সনাক্ত করেছে এবং সংস্থাগুলো আহতদের অতিমাত্রায় অভাব-সঙ্কটের মধ্যে বাঁচাতে চেষ্টা করছে। আল-আহলি ও আল-শিফা সহ প্রধান হাসপাতালগুলোর সামনে মরদেহ কাফনে মোড়ানো ও প্লাস্টিক ব্যাগে রাখা অবস্থায় দেখা গেছে; পরিবার-স্বজনরা বেহাল ও হতাশার মধ্যে শোক পালন করছেন।
ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, আল-কুদস হাসপাতালের বাইরে ইসরায়েলি বাহন মোতায়েন করা হয়েছিল এবং গুলিবর্ষণে হাসপাতালের অক্সিজেন স্টেশন অচল হয়ে পড়ার খবর আসে—যার ফলে জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জামের অনুপস্থিতি আরও অগণিত প্রাণ ঝুঁকির মুখে ফেলছে। আইডিএফ (ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স) দাবি করেছে যে হাসপাতালে সরাসরি হামলা হয়নি; তবু হাসপাতালের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় চিকিৎসা সেবা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
সামরিক বক্তব্য বনাম স্থানীয় রিপোর্ট — মিল না থাকা তথ্য
ইসরায়েলি বাহিনী বলেছে, তারা লক্ষ্য করে হামাসের দুই যোদ্ধাকে আঘাত করেছে; তাদের বিবরণ অনুযায়ী হতাহতের সংখ্যা তাদের তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অন্য দিকে হামাস পরিচালিত সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি জানিয়েছে, আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত একটি ওয়্যারহাউসে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গেছেন। বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের জন্য গাজা সিটিতে স্বাধীনভাবে ঢোকা নিষিদ্ধ থাকার কারণে ঘটনাগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করা কঠিন হয়—তবুও স্থানীয় হাসপাতাল, প্রত্যক্ষদর্শী এবং মানবিক সংস্থাগুলোর রিপোর্টগুলি মিলেমিশে একটি ভয়াবহ চিত্র উপস্থাপন করে।
বাস্তুচ্যুতি, স্থানান্তর ও দুর্ভিক্ষ ঝুঁকি
আইডিএফ সূত্রে জানা যায়, গত মাসে শুরু হওয়া অভিযানের পর থেকে প্রায় সাত লাখ মানুষ দক্ষিণ গাজার দিকে সরানো হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে; জাতিসংঘ ও মানবিক অংশীদাররা রিপোর্ট করেছেন দক্ষিণে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৬০০ জন অনুপ্রবেশ/স্থানান্তরের তথ্য মনিটর করেছে। তবে দক্ষিণেও অবকাঠামো সংকীর্ণ ও ব্যস্ত; ‘মানবিক এলাকা’ হিসেবে ঘোষিত স্থানগুলোও জনাকীর্ণ ও নিরাপত্তাহীন—অর্থাৎ বাস্তুচ্যুতরা যেখানে আশ্রয় নিতেই গেছে, সেখানেই জীবন-জীবিকা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা অনিরাপদ।
জাতিসংঘের সমর্থিত সংস্থা আগে থেকেই গাজার দুর্ভিক্ষের ঘোষণা করেছিল; এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে দুর্ভিক্ষ ও ভাইরাল রোগের ঝুঁকি বাড়িয়েছে—পর্যাপ্ত খাবার, নিরাপদ পানীয় জল, স্বাস্থ্যসেবা ও পটভূমি সাফাইয়ের অভাব দ্রুত মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হচ্ছে।
জিম্মি মুক্তি ও সামরিক কৌশল: উভয়পক্ষের দাবি
ইসরায়েলি বাহিনী বারবার বলছে তাদের লক্ষ্য স্থল অভিযানে জিম্মিদের মুক্তি ও হামাসের ‘চূড়ান্ত পরাজয়’ নিশ্চিত করা। আইডিএফ দাবি করেছে তারা শহরে বড় সংখ্যক সৈন্য নিয়ে অভিযান চালাচ্ছে এবং ‘জিম্মিদের মুক্তি’ তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। অন্যদিকে হামাসের সামরিক শাখা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে—যদি গাজা সিটিতে আক্রমণ বাড়ে, তাহলে বিদ্যমান জিম্মিদের জীবনের ওপর গুরুতর হুমকি পড়বে; তারা সতর্ক করেছে আনুমানিক ৪৮ জন জিম্মির জীবন ঝুঁকিতে থাকতে পারে এবং ধারণা করা হচ্ছে তাদের মধ্যে প্রায় ২০ জন এখনও জীবিত। উভয়পক্ষের এই প্রতিশ্রুতি ও হুঁশিয়ারি এক পরিচিত, ভয়ানক টানাপোড়েন তৈরি করছে—যার ভেতর পড়ে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি ‘২১ দফা শান্তি পরিকল্পনা’ উপস্থাপিত হওয়ার খবর এসেছে; তবে সেই পরিকল্পনার বিশদ এখনও প্রকাশ করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ মন্তব্য করেছেন যে এই পরিকল্পনা “ইসরায়েলের উদ্বেগের পাশাপাশি প্রতিবেশীর দুশ্চিন্তাও তুলে ধরে।” আন্তর্জাতিকভাবে নানা ধরণের কংক্লেভ ও তত্ত্বাবধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে বলে জানা গেলেও ময়দানে রক্তক্ষরণ থামাতে তাৎপর্যপূর্ণ স্থায়ী প্রভাব এখনও দেখা যায়নি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় উন্মুক্তভাবে গাজার ওপর সামরিক কৌশলকে কড়া সমালোচনা করেছে—বেসামরিক জনসংখ্যার ওপর হামলা ও বেসামরিক অবকাঠামো (অর্থাৎ হাসপাতাল, আবাসন) ক্ষতি করার ফলে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ও দীর্ঘমেয়াদি মানবিক দুর্দশা সৃষ্টি হচ্ছে বলে তারা সতর্ক করেছে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ও মানবিক মূল্যায়ন
-
মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন: বেসামরিক হানার উচ্চ সংখ্যা এবং হাসপাতাল, পানীয় জল ও খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন—এসব বিষয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও সংঘাত নিয়মের আলোচ্যবস্তু। কোন কোন কৌশল আইনসম্মত ও কোনটি নয়—এ নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনা/তদন্ত দাবি উঠতে পারে।
-
স্বাস্থ্যগত সংকট: অক্সিজেন স্টেশন ভাঙার মতো ঘটনাগুলো তৎক্ষণাৎ প্রাণহানির কারণ হিসেবে কাজ করে; পরবর্তী সময়ে সংক্রামক রোগ, খিদের বৃদ্ধিও বড় সমস্যা তৈরি করবে।
-
মানসিক ট্রমা: শিশু ও পরিবারগুলোতে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক কষ্ট ও ট্রমার ছাপ পড়বে, যা সমাজ পুনর্গঠনকে ব্যাহত করবে।
-
বাস্তুতন্ত্র ও পুনর্বাসন: বাড়িঘর ধ্বংস হলে, পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের ব্যয় প্রচুর—আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক খরচটি বহু বছর ধরে বহন করতে হবে।
সাক্ষাৎকার ও মানবিক কণ্ঠ (সংক্ষিপ্ত):
“আমাদের বাড়ি পুড়ে গেছে, আমি জানি না কোথায় যাবে আমার বাচ্চারা,”—এক বাস্তুচ্যুত মা, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, আল-শিফা হাসপাতালে কাঁদতে কাঁদতে এ কথাই বলেন। অন্য এক মেডিকেল কর্মী বলেন, “অক্সিজেন নেই, ফিডার সিস্টেম অচল—আমরা এমন পরিস্থিতি আগে দেখিনি; প্রতিটি রাত্রি ঝুঁকির মধ্যেই শেষ হয়।”
পরামর্শ ও জরুরি আহ্বান
-
সতর্ক ও স্বচ্ছ তদন্ত: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান—অবশ্যই তা দ্রুত এবং স্বচ্ছ হওয়া উচিত যাতে বেসামরিক হতাহতের কারণ ও দায়িত্বরত পক্ষ নির্ধারণ করা যায়।
-
মানবিক সহায়তা অবরুদ্ধ করা বন্ধ: গাজার নির্ধারিত হিউম্যানিটেরিয়ান কোরিডর ও সহায়তা অবাধে পৌঁছে দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চাপ বাড়াতে হবে। খাদ্য, ওষুধ, অক্সিজেন ও বাসস্থানীয় সহায়তা অবিলম্বে প্রয়োজন।
-
জিম্মিদের নিরাপত্তা ও মুক্তি: জিম্মিদের জীবন-নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যে কোনও কূটনৈতিক উদ্যোগকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার।
-
দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন পরিকল্পনা: স্থায়ী পুনর্বাসন, অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার জন্য তাত্ক্ষণিক এবং পরিকল্পিত তহবিলের পুনর্সৃষ্টি অপরিহার্য।
উপসংহার
গাজার এই সাম্প্রতিক ঘটনার পরিধি কেবল সংখ্যাগত—মরনোত্তর তালিকায় ৮০’র বেশি নাম—এতে সীমাবদ্ধ নেই। প্রত্যেক একটি নাম একটি পরিবারের ছিন্নমূল কাহিনি, প্রত্যেক একটি মরদেহ একটি গল্পের অবসান। হাসপাতাল, সড়ক, বাজার—সকলকিছু ক্ষতবিক্ষত। আন্তর্জাতিক কূটনীতিক প্রচেষ্টা যত দ্রুত কার্যকর হয় না, তত বেশি মানুষ ঝরে পড়বে। মানবিক সহায়তা, নিরপেক্ষ তদন্ত ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার তৎপর উদ্যোগ না নিলে গাজার জনজীবন বহু বছর ধরে ধ্বংসের ছায়ায় থাকবে।
পাঠকের মন্তব্য