দেশের বাজারে বর্তমানে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে এক ধরনের দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করেছে। একদিকে যেমন চড়া দামে সবজি, মাছ, মুরগির ডিম কেনা যাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে আটা, ময়দা, মসুর ডালসহ আরও বেশ কিছু পণ্যের দামও গত এক সপ্তাহে বেড়েছে। এখন এই মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপণ্য, যা প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসের অংশ। বিশেষ করে, আটা, ময়দা এবং মসুর ডালের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আটা ও ময়দার দাম কেজিতে ৬ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। এর পাশাপাশি, মসুর ডালের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২০ টাকা, যা ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে হয়েছে। বাজারে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দাম বৃদ্ধি সরাসরি উৎপাদন খরচের বৃদ্ধি, পরিবহন খরচের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে হয়েছে। রাজধানীর বাজারে মূল্যবৃদ্ধির চিত্র গতকাল বৃহস্পতিবার, রাজধানী ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে আমরা এই মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করেছি। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, টাউন হল বাজার, আগারগাঁও তালতলা বাজার এবং কারওয়ান বাজারের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে সাধারণ ক্রেতাদের জন্য এটি হয়ে উঠছে একটি বড় সংকট। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের একজন বিক্রেতা জানান, “আটা, ময়দা এবং মসুর ডাল একসঙ্গে দাম বেড়েছে, ফলে ক্রেতাদের কাছে কেজি প্রতি ৫-১০ টাকা বাড়ানো কিছুটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, আমাদের জন্য মুনাফা বাড়ছে, কিন্তু ক্রেতাদের সমস্যা হচ্ছে।” তিনি আরও জানান, “চিনির দাম কিছুটা কমেছে, কিন্তু অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা এতটা খুশি নয়।” দাম বৃদ্ধির পেছনে কারণ কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, পণ্যের উৎপাদন কম হওয়া এবং পরিবহন খরচের বৃদ্ধি এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সেচ সমস্যা এবং উৎপাদন খাতে পর্যাপ্ত পরিকল্পনা না থাকায় সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যার ফলে দাম বেড়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবও বাংলাদেশের বাজারে অনুভূত হচ্ছে, যা স্থানীয় মূল্যবৃদ্ধির কারণ হতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাজারে মসুর ডালের দাম বৃদ্ধি পাওয়া। গত এক মাসে ডালের দাম প্রায় ২০ টাকা বেড়েছে, যা সাধারণ জনগণের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে যেমন দেশীয় উৎপাদন কমছে, তেমনি অন্যদিকে বাইরের দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যগুলোর দামও বৃদ্ধির মুখে পড়েছে। এতে সরবরাহের ঘাটতি বাড়ছে এবং দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব বাজারে মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনে পড়ছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এটি একটি বড় চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আটা, ময়দা, ডাল, চিনি, মসলাপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবারের প্রতিদিনের খরচ অনেকটাই বেড়ে গেছে। যারা আগের মতো পণ্য কিনতে পারতেন, তারা এখন অনেকেই সাশ্রয়ী পণ্যগুলো খুঁজছেন এবং দাম কমানোর জন্য কৌশল অবলম্বন করছেন। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধি দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকলে দেশে একটি মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যা সাধারণ মানুষের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।” কিছু পণ্যের দাম কমেছে যদিও বেশিরভাগ পণ্যের দাম বেড়েছে, তবুও কিছু পণ্যের দাম কমেছে, যেমন চিনি ও কিছু মসলাপণ্যের দাম। মিষ্টি ও মসলাপণ্যের দাম কমার কারণে কিছুটা হলেও বাজারের চাপ কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম কমার পেছনে সম্ভবত বিশ্ব বাজারে চিনি ও মসলাপণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি এবং উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ার বিষয়টি প্রভাব ফেলেছে। সরকারের জন্য করণীয় অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকার যদি দ্রুত দাম নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে এই অবস্থা দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। তাই সরকারকে এই বিষয়ে দ্রুত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরবরাহ শৃঙ্খলা, উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পনা এবং খুচরা বাজারে চাহিদার চিত্র বুঝে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। রাজধানীর আগারগাঁও এলাকার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এখন মাসের শেষ। পকেটে টাকাপয়সা কম। এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে সবজি ও মুরগির ডিম অতিরিক্ত দামে কিনছি। এখন আটা ও ডালের দামও বাড়ল। সব মিলিয়ে খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি।’ বিক্রেতারা জানান, খোলা ও মোড়কজাত (প্যাকেট) উভয় ধরনের আটা ও ময়দার দামই বেড়েছে। ১৫ দিন আগে মোড়কজাত আটা (দুই কেজি) কেনা যেত ৯০–৯৫ টাকায়। এখন সেই দাম বেড়ে ১১০–১১৫ টাকা হয়েছে। আর খোলা আটার কেজি ৩৮–৪০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫–৪৮ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ আটার দাম কেজিতে ৬ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে দুই সপ্তাহ আগে মোড়কজাত (দুই কেজি) ময়দার দাম ছিল ১৩০ টাকা, যা বেড়ে ১৪০ টাকা হয়েছে। খোলা ময়দার দামও কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৫৫ টাকা হয়েছে। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের মুদি বিক্রেতা ও ইমাম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. ইমাম হাসান বলেন, ‘বাজারে আটা ও ময়দার কিছুটা সরবরাহ–সংকট রয়েছে। একটি বড় ভোগ্যপণ্য কোম্পানির আটা–ময়দা একদমই বাজারে নেই। এ অবস্থায় দাম বাড়িয়েছে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো। যদিও তারা গায়ে বাড়তি দাম লেখা প্যাকেট বাজারে ছাড়েনি। তবে আমাদের (খুচরা বিক্রেতা) কাছ থেকে আগের চেয়ে বেশি দাম রাখা হচ্ছে। তাই আমরাও সে অনুপাতে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছি।’ এ বিষয়ে একটি ভোগ্যপণ্য বিক্রেতা কোম্পানির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘বর্তমানে আটা তৈরির জন্য ব্যবহৃত গমের কিছুটা সরবরাহ–সংকট আছে। এ কারণে দাম বেড়েছে। নতুন করে গম আমদানি হলে দাম কমে আসবে আশা করছি।’ তবে গমের সরবরাহ–সংকটের বিষয়টি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। বাসাবাড়িতে রান্নার আরেক প্রয়োজনীয় পণ্য মসুর ডাল। গত দুই সপ্তাহের মধ্যে ছোট দানার মসুর ডালের দাম কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ১৫০–১৬০ টাকা হয়েছে। আর মোটা দানার মসুর ডালের দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ১০৫ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া মুগডালের দাম কেজিতে ২৫ টাকা ও ছোলার দাম ১০ টাকা করে বেড়েছে। বাজারে চালের দাম এখনো বাড়তি রয়েছে। অবশ্য গত সপ্তাহে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে এক–দেড় টাকা কমেছে। বর্তমানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের মধ্যে প্রতি কেজি ডায়মন্ড, মঞ্জুর ও সাগর ৮০ টাকা, রশিদ ৭২ টাকা ও মোজাম্মেল মিনিকেট ৮৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর মানভেদে প্রতি কেজি নাজিরশাইল চালের দাম এখন ৭৫–৯৫ টাকা। এ ছাড়া ব্রি–২৮ চাল ৬০ টাকা ও মোটা ধরনের স্বর্ণা চাল ৫৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে কেজিতে ১০ টাকা করে দাম বেড়েছে পোলাও চালের। বর্তমানে বাজারে সবজির দাম বেশ চড়া। অধিকাংশ সবজির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকার বেশি দামে। অন্যদিকে সম্প্রতি ফার্মের মুরগির বাদামি রঙের ডিমের দাম ডজনপ্রতি বেড়ে ১৫০ টাকা ছাড়িয়েছিল। সেটি কমে এখন ১৪০ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৮০ টাকা ও সোনালি মুরগি ২৯০–৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আটা, ময়দা ও মসুর ডালের দাম বেড়েছে

পাঠকের মন্তব্য