• হোম > এক্সক্লুসিভ | দক্ষিণ আমেরিকা > বিশ্বের ‘অভিশপ্ত’ চার রত্নের ইতিকথা

বিশ্বের ‘অভিশপ্ত’ চার রত্নের ইতিকথা

  • বুধবার, ১১ মার্চ ২০২০, ০৯:২১
  • ৮০৯

কোহিনুর

রত্ন, শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে উজ্জ্বল রঙের ঝলমলে পাথরের ঝিলিক। হিরে, চুনি, পান্নার প্রতি মানুষের আকর্ষণ ছিল যুগ যুগ ধরেই। বরং সময়ে সাথে সাথে তা বেড়েছে বই কমেনি।

ইতিহাস সাক্ষী, পাথর হস্তগত করতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছেন রাজা-বাদশারা। ফলে যুদ্ধ-হানাহানি-দুঃখ-রক্তপাতের সঙ্গে কোথাও যেন ওতোপ্রেতোভাবে জড়িয়ে গিয়েছে কয়েকটি রত্নের ইতিহাস। মিলেছে ‘অভিশপ্তের’ তকমা। সেই রত্নগুলি তাদের মালিকদের জীবনে নাকী দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে। যদিও অনেকের দাবি, রত্নগুলির সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ গল্প মিথ্যে। তার কোনও বাস্ত ভিত্তি নেই।

রত্নগুলির বাজার দর বাড়াতেই রং চড়ানো এই গল্পের সংযোজন বলেও দাবি করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিই হোক বা কাকতালীয় ঘটনা কিছু না কিছু ঘটেছেই। আর সেটাকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে অভিশাপের কাহিনী। অভিশপ্ত সেই রত্নগুলি সম্পর্কে কথিত মিথ নিয়েই আমাদের আজকের এই প্রতিবেদন।

হোপ ডায়মন্ড
অভিশপ্ত রত্নের তালিকার প্রথমেই রয়েছে হোপ ডায়মন্ড। এটি আসলে নীলা বা নীল রঙের হিরে। যেটি ১৬৬৮ সালে ভারত থেকে কিনেছিলেন ফরাসি ব্যবসায়ী জাঁ ব্যাপটিস্ট ত্রাভিনিয়ে। হিরেটি কেনার কিছুদিনের মধ্যে তিনিই সেটিকে ফরাসি রাজপরিবারকে বিক্রি করে দেন।

ফরাসি বিপ্লবের আগে পর্যন্ত এটি ফ্রান্সের রাজাদের মুকুটের শোভা বাড়িয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের পর ১৭৯২ সালে সেটি আচমকাই হারিয়ে যায়। তারপর বেশ কয়েকদিন সেটির কোনও খোঁজ মেলেনি।

১৮১২ সালে লন্ডনের ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল এলিয়াসনের কাছে এই হিরেটি দেখা যায়। কাটিংয়ের ফলে হিরেটির জেল্লা তখন আরও বেড়েছে। কয়েকজনের হাত ঘুরে সেটি লন্ডনেরই রত্ন সংগ্রাহক হেনরি ফিলিপ হোপের হাতে এসে পড়ে। এনারে নামেই এই হিরের নাম ‘হোপ ডায়মন্ড’।

এই সময় থেকেই হিরেটির সঙ্গে অভিশাপের কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে। কথিত আছে, হিরেটি কেনার পরই হোপ পরিবারের অধিকাংশ ব্যক্তির রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়।

এরপর এটিকে কিনে নেন পিয়েরে কারতিয়ে। তবে সেটিকে তিনি নিজের কাছে রাখেননি। বিক্রি করে দিয়েছিলেন মার্কিন ধনকুবের এভালিন ওয়ালশ ম্যাকলিনের কাছে হিরেটি বিক্রি করেন। আশ্চর্যের বিষয় অভিশপ্তের গল্প শুনেই এটি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এভালিন।

১৯১১ সালে ১ লক্ষ ৮৯ হাজার ডলারের বিনিময়ে এটি কেনেন তিনি। এরপরই এভালিনের পরিবারেও নেমে আসে অভিশাপের ছায়া। গাড়ি দুর্ঘটনায় এভালিনের ছেলের মৃত্যু হয়। তার স্বামী অন্য একজনের সঙ্গে পালিয়ে যান। ঘুমের ওষুধের ওভারডোজে এভালিনের মেয়ের মৃত্যু হয়। এমনকী এভালিনের পারিবারিক মালিকানাধীন সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট দেউলিয়া হয়ে যায়। সমস্ত ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে এভালিনের সমস্ত গয়না বিক্রি করতে হয়। যার মধ্যে ছিল ওই হিরেটিও।

বর্তমানে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের জাদুঘরে রয়েছে ‘হোপ ডায়মন্ড’-টি। ১৯৫৮ সালে এই হিরেটি সেখানে দান করা হয়। প্রতিবছর বহু দর্শক সেটিকে দেখতে আসেন।

কোহিনুর
জন্মস্থান ভারত হলেও এই বিশ্বখ্যাত হিরেটি এখন আছে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মুকুটে। ইতিহাসবিদদের দাবি, ভারতের গোলকুণ্ডা খনি থেকে এই হিরেটির উৎপত্তি।

কথিত আছে, ভারতে এক দেবীর প্রতিমায় চোখের মণি হিসেবে কোহিনুর ব্যবহৃত হতো। এরপর স্থানীয় রাজাদের হাত ঘুরে একসময় সেটি মোঘল সম্রাট বাবরের হাতে আসে।

পরে সম্রাট শাহজাহান ময়ূর সিংহাসনে খোদাই করে রেখেছিলেন এই হিরেটিকে। শুরুতে এই হিরের ওজন ছিল ৯৮৬ ক্যারাট। সৌন্দর্য বাড়াতে কাটিং করা হলে তা পরে দাঁড়ায় ৮০০ ক্যারাটে। পরে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের শাসন চলাকালীন হিরেটি জাহাজে করে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সময়ই এই হিরেটিকে নিয়ে গোলমাল শুরু হয়। জাহাজের মাঝি-মাল্লাদের একাংশ দাবি করেছিল হিরেটি অভিশপ্ত। এটি লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার সময় আচমকাই জাহাজে কলেরা দেখা দেয়। একে একে মৃত্যু হতে থাকে নাবিকদের। মরিশাসে যাত্রাবিরতির সময় কোহিনুরের অভিশাপের কাহিনী চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর প্রবল ঝড়ের মুখে পড়েছিল সেই জাহাজ। শেষে ব্রিটিশ রাজপরিবারের হাতে হিরেটি পৌঁছলেও অনেকেই নাকি খুশি হননি।

কথিত আছে ওই দেবীর অভিশাপ রয়েছে এই হিরেতে। ফলে কোনও পুরুষই নাকী এই হিরে ব্যবহার করতে পারবেন না। তা হলেই ঘটবে সর্বনাশ। অদ্ভূত ব্যাপার কোহিনুর হাতে পাওয়ার পরবর্তী কালেও রাজপরিবারের কোনও পুরুষই এটিকে নিতে চাননি।

দ্য ব্ল্যাক প্রিন্স’স রুবি
ব্রিটিশ রাজপরিবারের মুকুটে রয়েছে বড় আকারের লাল রঙের ‘চুনি’ রয়েছে। রাজপরিবারের অভিষেক অনুষ্ঠানে এই রত্নখচিত মুকুটের দেখা মিলেছে। এই পাথরের নাম ‘দ্য ব্ল্যাক প্রিন্স’স রুবি’।

অনেকের দাবি, এটি আসলে চুনি নয়। বরং লাল রঙের একটি বিশেষ খনিজ পদার্থ। তবে তা মানতে নারাজ রত্ন বিশারদরা। চতুর্দশ শতকে ব্রিটিশ রাজপরিবারের দখলে আসে এই রত্ন। গ্রেনাডার সুলতানের মৃতদেহের কাছে থেকে পাওয়া গিয়েছিল এটি। পরে ‘ব্ল্যাক প্রিন্স’ নামে খ্যাত এডওয়ার্ড অব উডস্টকের হাতে আসে চুনিটি। এক ভয়াবহ যুদ্ধে বিপক্ষকে পরাজিত করার পর হিরেটি পান তিনি। এর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই আচমকা মারা যান তিনি।

এই ঘটনার পর থেকে অভিশাপের গল্প এই চুনিটির সঙ্গে ওতোপ্রেতোভাবে জড়িয়ে যায়। কথিত আছে, চুনিটি নিয়ে যুদ্ধ করতে গেলেই এর মালিকরা পরাজিত হয়েছেন অথবা তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। ব্রিটিশ রাজমুকুটে শোভা পাওয়ার পরও এই চুনির অভিশাপ শেষ হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডের মাটিতে জার্মানির বোমাবর্ষণের ঘটনার জন্যও অনেকে এই পাথরকে দায়ী করে থাকেন।

ব্ল্যাক অরলভ
কালো রঙের এই হিরের গল্প আগাগোড়াই গোলমেলে। তবে এই হিরের কাহিনী যে বেশ খানিকটা রঙ চড়ানো তা অনেকেই জোর গলায় স্বীকার করেছেন। কথিত আছে, পুদুচেরির মন্দিরের এক প্রতিমার চোখ হিসেবে খোদাই করে বসানো ছিল এই রত্নটি। পরে নাকী কোনও এক সাধু তা চুরি করেন। সেই থেকেই অভিশাপের শুরু। এরপর বহু হাত ঘুরে এই হিরে পৌঁছায় রাশিয়ায়। মূলত রুশ দুই রাজকন্যার অলঙ্কার হিসেবেই ‘ব্ল্যাক অরলভ’-এর পরিচিতি। শোনা যায় কালো এই হিরেটি ছিল রাজকন্যা নাদিয়া অরলভের। তাঁর নাম থেকেই রত্নটির নামকরণ হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই দুই রাজকন্যাই নাকী প্রাসাদের উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

এরপর জে ডব্লিউ প্যারিস নামের এক হিরে ব্যবসায়ী ব্ল্যাক অরলভটিকে কিনে আমেরিকায় নিয়ে যান। কিন্তু সেই ব্যবসায়ীও নাকি নিউইয়র্কের উঁচু একটি বিল্ডিং থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। তবে হিরে বিশেষজ্ঞ ইয়ান বেলফোর তাঁর ‘ফেমাস ডায়মন্ডস’ নামক বইয়ে লিখেছেন যে ভারতে কালো রঙের কোনও হিরের অস্থিত্ব মেলেনি। এমনকি নাদিয়া অরলভ নামে কোনও রুশ রাজকন্যাও আদতে ছিল না বলে দাবি করেছেন তিনি। তবে এসব তথ্য ব্ল্যাক অরলভের অভিশপ্তের গল্পে বিন্দুমাত্র ভাটা আনতে পারেনি।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/890 ,   Print Date & Time: Saturday, 11 October 2025, 09:30:26 PM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh