• হোম > অর্থনীতি > খেলাপি ঋণের সত্য উন্মোচন—সংস্কারে জোর

খেলাপি ঋণের সত্য উন্মোচন—সংস্কারে জোর

  • মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:০৪
  • ৩৫

---

বহুমাত্রিক সংকট, অবমূল্যায়িত মুদ্রা, কমে যাওয়া রিজার্ভ, ঋণখেলাপির পাহাড়—সব মিলিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েই দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ. মনসুর। আজ তিনি বললেন, “সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আর্থিক খাত এখন একটি টেকসই ভিত্তির দিকে এগোচ্ছে এবং সেখানে দৃশ্যমান অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।”

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে ‘বাংলাদেশ স্টেট অব দ্য ইকোনমি ২০২৫’ এবং ‘এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদন ২০২৫’ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে গভর্নর তুলে ধরলেন দেশের অর্থনীতির বাস্তব অবস্থা, চ্যালেঞ্জ এবং এগিয়ে যাওয়ার রূপরেখা। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)।


মুদ্রা, রিজার্ভ ও ঋণখেলাপির আগুন থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা

দায়িত্ব পাওয়ার সময় দেশে যে বড় সংকটগুলোর মুখে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন—তা তিনি আলোচনায় স্পষ্ট করে তুলে ধরেন। দ্রুত অবমূল্যায়িত বিনিময় হার, সংকুচিত বৈদেশিক রিজার্ভ, হু-হু করে বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট এবং ব্যাহত বাণিজ্যপ্রবাহ—এসবই ছিল এক অনিশ্চিত অধ্যায়।

গভর্নর বলেন, “আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম, বিনিময় হার স্থিতিশীল না হলে মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয় সম্ভব নয়।”
দায়িত্ব গ্রহণের সময় যখন প্রতি ডলারের বিনিময় হার প্রায় ১২০ টাকায় পৌঁছে গেছিল, এখন তা বাজারভিত্তিক ব্যবস্থায় এসে স্থিতিশীল অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। একইসঙ্গে রিজার্ভেও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন—এক বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের উন্নতি।

তিনি জানান, চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত, আর্থিক হিসাবেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি এবং সামগ্রিক পরিশোধ ভারসাম্য এখন উদ্বৃত্তে—যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য বড় স্বস্তি।


সুদহার কমবে না এখনই—কারণ মূল্যস্ফীতি এখনও নিয়ন্ত্রণের পথে

মূল্যস্ফীতি ১২.৫% থেকে কমে ৮%-এর ওপরে নেমে এলেও গভর্নরের মতে, এখনই সুদের হার কমানোর কোনো সুযোগ নেই। বাস্তব সুদহার সামান্য ইতিবাচক রাখাই অর্থনীতির জন্য জরুরি।

তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন, “মুদ্রানীতি পুরোপুরি বাজারভিত্তিক থাকবে। সুদহারে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই।”

সরকারের ঋণ গ্রহণের কারণে অর্থবাজারে কিছু চাপ তৈরি হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনোভাবেই অর্থছাপায় যায়নি বলেও তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে জানান।


খেলাপি ঋণের বাস্তব চিত্র: লুকানো সত্য উন্মোচন

ড. মনসুরের বক্তব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল দীর্ঘদিনের ঢাকা ধুলোয় ঢাকা থাকা সত্য—প্রকৃত খেলাপি ঋণের ভয়াবহ বাস্তবতা।

তার ভাষায়,
“প্রকৃত খেলাপি ঋণের হার ৩৫ শতাংশেরও বেশি। এটি স্বীকার করা অস্বস্তিকর হলেও এটি বাস্তব সত্য।”

এই স্বচ্ছতা ব্যাংকিং খাতের গভীর সমস্যাগুলোর মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস ও ইচ্ছারই প্রমাণ।

তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন—ডিসেম্বরের মধ্যেই খেলাপি ঋণে উল্লেখযোগ্য হ্রাস লক্ষ্য করা যাবে।


সংস্কারের ঝড়: বোর্ড পুনর্গঠন থেকে একীভূতকরণ পর্যন্ত

বিদ্যমান জটিল সংকট মোকাবিলা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে নিয়েছে একাধিক কঠোর সংস্কারমূলক সিদ্ধান্ত—

  • ১৪টি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন

  • ৫টি ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায়

  • ৯টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসান প্রক্রিয়া চলমান

  • আমানত বীমা আইন, ব্যাংক রেজোলিউশন অধ্যাদেশ ও ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন

  • বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ পর্যালোচনা—স্বায়ত্তশাসন বাড়াতে

গভর্নর জানালেন, একীভূত নতুন ব্যাংকগুলো প্রথম বা দ্বিতীয় বছরের মধ্যেই লাভজনক অবস্থায় যেতে পারে। আর লোকসানি প্রতিষ্ঠানের জন্য “লভ্যাংশ নয়, বোনাস নয়” নীতিমালা কঠোরভাবে কার্যকর রয়েছে।

যেসব কর্মকর্তা প্রদত্ত ঋণ অল্প সময়েই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে—তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে।


বড় শিল্পখাত সচল রাখতে যৌথ উদ্যোগ

বড় ঋণখেলাপিদের সংশ্লিষ্ট শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকলেও গভর্নর জানান—বিদ্যুৎ ও বড় শিল্পখাতে কোনো প্রতিষ্ঠান অর্থায়নের অভাবে বন্ধ হয়নি। কারণ ঝুঁকি বিবেচনায় সরকার ও ব্যাংক একসঙ্গে এগিয়ে এসেছে—যাতে কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।


সময়ের দাবি—সংস্কার অব্যাহত রাখা

শেষ বক্তব্যে গভর্নর স্পষ্ট করে দেন—বৈদেশিক খাত এখন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আর্থিক খাতে পূর্ণ স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন সময়, ধৈর্য এবং অব্যাহত সংস্কার।
তিনি বলেন—“আমরা যে কাঠামোগত ও আইনি সংস্কার শুরু করেছি, তা অব্যাহত থাকতে হবে। আসছে সরকারও এসব সংস্কার ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নেবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”

এই বক্তব্য যেন শুধু আর্থিক প্রতিবেদনের ভাষ্য নয়—এটি এক জাতির অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের যাত্রাপথে প্রয়োজনীয় সত্য, সাহস ও দায়িত্ববোধের প্রতিফলন।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/7608 ,   Print Date & Time: Wednesday, 17 December 2025, 11:55:26 AM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh