• হোম > বিদেশ > ভারত–গালফ জোটে নতুন ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতা

ভারত–গালফ জোটে নতুন ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতা

  • মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৭
  • ৪৩

---

সম্প্রতি শারজাহতে অনুষ্ঠিত মিডল ইস্ট ইনভেস্টমেন্ট ফোরাম আবারও প্রমাণ করেছে—ভারত ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্ক এখন পুরোনো সীমা ছাড়িয়ে বহুস্তরীয়, গভীর ও কৌশলগত রূপ পেয়েছে। একসময় যেখানে তেল ও শ্রম ছিল দুই পক্ষের সম্পর্কের প্রধান চালিকাশক্তি, আজ সেখানে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি, বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, ডিজিটাল পাওয়ার এবং বৈশ্বিক ভূ-অর্থনীতির নতুন বাস্তবতা।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে যখন ভারতীয় রপ্তানি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান হারায়, তখন ভারতীয় কোম্পানিগুলো দ্রুতই নতুন পথ খুঁজে নেয়। তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ব্যবহার করতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের ‘গেটওয়ে’ হিসেবে। এই কৌশলগত পদক্ষেপ ভারত-উপসাগরীয় সম্পর্ককে নতুন স্তরে উন্নীত করেছে—যা আজ একটি আঞ্চলিক জোট হিসেবে শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করছে।


ঐতিহাসিক সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞা

শতাব্দী ধরে মসলা, কাপড় এবং বাণিজ্যিক জাহাজ ভারত ও উপসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ব্রিটিশ আমলে উপসাগরের বহু দেশ প্রশাসনিকভাবে দিল্লির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর সম্পর্ক বহু বছর ছিল লেনদেনভিত্তিক—তেল রপ্তানি বনাম শ্রমশক্তি।

কিন্তু গত দশকে দুই পক্ষের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন সবকিছু পাল্টে দেয়।
২০১৫ সালে ৩৪ বছর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর ছিল একটি ঐতিহাসিক বাঁকবদল। একই সময়ে সৌদি আরব ও ইউএই ঘোষণা করে—তারা তেলের বাইরে প্রযুক্তি, পর্যটন, সবুজ অর্থনীতি ও শিল্পায়নে মনোযোগ দেবে। ভারতের দ্রুত ডিজিটালাইজেশন ও শিল্পায়নের যাত্রায় এই অঞ্চল হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সঙ্গী।


ডিজিটাল যুগের সমন্বয়: নতুন উন্নয়ন মডেল

ভারত-উপসাগরীয় জোটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তাদের ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা।
ভারতের সাশ্রয়ী, ওপেন-সোর্স ডিজিটাল সিস্টেমের সঙ্গে উপসাগরীয় এলাকার বিপুল পুঁজির মিলন ঘটাচ্ছে—

  • আধুনিক অবকাঠামো

  • অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল পরিচয় ব্যবস্থা

  • জলবায়ুবান্ধব প্রকল্প

  • দক্ষতা উন্নয়ন

  • এবং সর্বোপরি ভালো মজুরির স্থায়ী কর্মসংস্থান

এই মডেল ইতোমধ্যেই একটি নতুন “ভূ-অর্থনৈতিক জোট” এর রূপ নিয়েছে।


বাণিজ্যিক সাফল্য: এক নজরে সংখ্যা

  • ভারত–ইউএই বাণিজ্য: ১০০ বিলিয়ন ডলার

  • ভারত–সৌদি বাণিজ্য (২০২৩–২৪): ৪৩ বিলিয়ন ডলার

  • মুবাদালা ও সৌদি PIF-এর বিনিয়োগ: স্টার্টআপ, সবুজ শক্তি ও অবকাঠামোতে বহুগুণ বৃদ্ধি

এই বিনিয়োগগুলো এককালীন নয়—বরং ‘দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ’, যা দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও প্রবৃদ্ধিকে স্থায়ী রূপ দিচ্ছে।


আফ্রিকায় নতুন ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা

ভারত-উপসাগরীয় সম্পর্ক এখন আফ্রিকা পর্যন্ত প্রসারিত।

  • ইউএই ঘোষণা করেছে—১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ

  • সৌদি আরব—৪১ বিলিয়ন ডলার উন্নয়ন প্রোগ্রাম

  • আর ভারত নিয়ে গেছে শান্তিরক্ষা, অবকাঠামো ও প্রবাসী সম্প্রদায়ের সেতুবন্ধনের অভিজ্ঞতা

নতুন ত্রিপক্ষীয় মডেলে ইউএই’র পুঁজিতে ভারতীয় কোম্পানিগুলো আফ্রিকায় অবকাঠামো নির্মাণ করছে—যা বড় শক্তিগুলোর ঋণনির্ভর বা রাজনৈতিক শর্তযুক্ত প্রকল্পের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য ও মানবকেন্দ্রিক।


মধ্যম আকারের দেশগুলোর জন্য নিরাপদ মডেল

বিশ্ব যখন যুক্তরাষ্ট্র–চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনিশ্চিত হয়ে উঠছে, তখন মধ্য ও ছোট দেশগুলোর জন্য ভারত–উপসাগরীয় জোট একটি ‘নিরাপদ, স্থিতিশীল ও রাজনৈতিক দাসত্ববিহীন’ উন্নয়ন মডেল হিসেবে উঠতি গুরুত্ব পাচ্ছে।
এটি “নন-অ্যালাইনমেন্ট” নয়—বরং এক নতুন “মাল্টি-অ্যালাইনমেন্ট”—যেখানে স্বাধীনতা, পারস্পরিক লাভ ও বাস্তব কৌশলই প্রধান।


চ্যালেঞ্জ থাকলেও আস্থাই প্রধান শক্তি

আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বৈশ্বিক অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এই জোটের সম্ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করে। তবু দুই পক্ষের আস্থা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
তারা নিজেদের স্বার্থেই তৈরি করছে ভবিষ্যতের পথ—অন্য কোনো শক্তির নির্দেশনায় নয়।

 

যদি এই জোট টেকসই হয়, তবে তা শুধু দ্বিপক্ষীয় নয়—বিশ্বব্যাপী উদীয়মান অর্থনীতির জন্যও একটি মানবকেন্দ্রিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও স্থিতিশীল উন্নয়নের শক্তিশালী নমুনা হয়ে উঠবে।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/7606 ,   Print Date & Time: Wednesday, 17 December 2025, 01:36:57 PM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh