![]()
মার্কিন ডলারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারতের রুপি চলতি বছরে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে। বছরের শুরু থেকে নভেম্বর শেষ পর্যন্ত রুপির অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৫ শতাংশ, যা শুধু পরিসংখ্যানগত সংকট নয়—দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, সাধারণ মানুষের জীবনযাপন, বাংলাদেশি পর্যটক ও রোগী—সবখানেই এর মানবিক প্রভাব পড়ছে।
মঙ্গলবার সকালে আরবিআই (রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া) প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, প্রতি ডলারের বিপরীতে রুপির মান দাঁড়িয়েছে ৮৯.৭৪ রুপি—যা দিনের হিসেবে আরও ০.৩২% পতন।
নভেম্বরে রুপির পতন ছিল ০.৮%, এবং ৩০ নভেম্বর রুপি সর্বকালীন নিম্নমানে গিয়ে ঠেকে ৮৯.৭৯-এ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি শুধু বাজারের সংকট নয়, বরং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, আমদানি খরচ, জ্বালানি মূল্য ও মানবিক নিরাপত্তার ওপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করছে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশিরা কীভাবে প্রভাবিত?
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ চিকিৎসা, ব্যবসা ও পর্যটনের জন্য ভারতে যায়। যদিও বর্তমানে ভিসা জটিলতায় সংখ্যাটি অনেক কমছে, তবুও যারা যাচ্ছেন—তাদের জন্য এই দরপতন কিছুটা ‘দ্বিমুখী প্রভাব’ তৈরি করেছে।
১. ডলার স্থিতিশীল—রুপি সস্তা: বাংলাদেশিরা লাভবান
বাংলাদেশে ডলারের বাজার কয়েক মাস ধরে ১২২ টাকার মধ্যেই স্থির। ফলে ডলার ভাঙালে
আগের চেয়ে বেশি রুপি হাতে আসছে।
চিকিৎসা ব্যয়, হোটেল-যাতায়াত ও কেনাকাটার চাপ কিছুটা কমছে।
এটি নিঃসন্দেহে ভারতগামী সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির খবর।
২. কিন্তু পেছনে আছে বৃহত্তর ঝুঁকি
রুপি দুর্বল হলে ভারতের আমদানি খরচ বাড়বে, বিশেষ করে তেল ও শিল্পপণ্যের ক্ষেত্রে। ফলে—
▪ ভারতের বাজারে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে
▪ ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে
▪ চিকিৎসা পরিষেবার খরচ বাড়তে পারে
▪ দুই দেশের বাণিজ্যে চাপ তৈরি হতে পারে
অর্থাৎ স্বল্পমেয়াদে লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদে এই সংকট দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশের ওপর চাপ বাড়াতে পারে।
রুপির ধসের কারণসমূহ: বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক চাপ
১. যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি ও ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক চাপ
বিশেষজ্ঞদের মতে, রুপির পতনের সবচেয়ে বড় কারণ হলো—
-
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আরোপিত শুল্ক
-
দীর্ঘ আলোচনার পরও ভারত–যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যচুক্তি চূড়ান্ত না হওয়া
ফলে বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, যা রুপির ওপর সরাসরি চাপ ফেলছে।
২. রাশিয়া থেকে তেল আমদানি কমে যাওয়া
ইইউ–মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারত রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি কমিয়েছে।
আগে যেখানে দিনে ১৭ লাখ ব্যারেল রুশ তেল আসত—
এখন বিকল্প উৎস হিসেবে ভারতকে সুদূর
গায়ানা এবং পশ্চিম এশিয়া থেকে তেল আনতে হচ্ছে।
এতে পরিবহন খরচ বেড়েছে
ডলারের ওপর চাপ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে
৩. বিদেশি মুদ্রার দুই সূচকেই পতন
এনইইআর (Nominal Effective Exchange Rate) এবং আরইইইআর (Real Effective Exchange Rate)—দুই সূচকই রুপির দুরবস্থা দেখাচ্ছে।
আরবিআই বলছে,
-
অক্টোবরের এনইইআর: ৮৪.৫৮ (গত বছর ছিল ৯০.৮৫)
-
অক্টোবরের আরইইইআর: ৯৭.৪৭
দুই সূচকই চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, অর্থাৎ রুপি এখন সত্যিই দুর্বল।
৪. বিশ্বের প্রধান চার মুদ্রার বিরুদ্ধেও পতন
২০২৪ সালে রুপি—
-
ডলার
-
পাউন্ড
-
ইউরো
-
ইয়েন
-
ইউয়ানের
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি পতন হয়েছে।
ফলে রুপিকে এশিয়ার সবচেয়ে দুর্বল মুদ্রার ‘অপ্রীতিকর খেতাব’ বহন করতে হচ্ছে।
ভারতের ভবিষ্যৎ: কি অপেক্ষা করছে?
বিশ্লেষকদের মত—
রুপি আগামী কয়েক সপ্তাহে ৯০ ছাড়াতে পারে যদি
▪ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি না হয়
▪ তেলের দাম আবার বাড়ে
▪ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে চাপ বাড়ে
রুপির মান আরও কমলে—
-
আমদানির খরচ বাড়বে
-
মূল্যস্ফীতি বাড়বে
-
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে
-
আর সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও তীব্র হবে
এই পরিস্থিতিতে ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় বাজেট উপস্থাপনের আগে ভারতের অর্থমন্ত্রী শিল্প ও মধ্যবিত্তের চাপ সামাল দিতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন।