• হোম > বাংলাদেশ > বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে বন্দর—স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন

বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে বন্দর—স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন

  • মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৪১
  • ২৫

---

বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ নৌ ও কনটেইনার টার্মিনালগুলো বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তকে ঘিরে সারাদেশে জোর আলোচনা চলছে। এই সিদ্ধান্তকে কেউ দেখছেন আধুনিকায়নের বড় সম্ভাবনা হিসেবে, আবার কেউ দেখছেন জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি হিসেবে। এর ফলে বন্দর-নির্ভর কয়েক লাখ শ্রমিক, কর্মচারী, এজেন্ট, আমদানি-রপ্তানিকারক এবং নৌ-সংশ্লিষ্ট মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে গভীর উদ্বেগ।

কোন টার্মিনাল কার হাতে যাচ্ছে

চট্টগ্রামের লালদিয়া টার্মিনাল ৩০ বছরের জন্য যাচ্ছে ডেনমার্কভিত্তিক এপি মোলার মায়ের্স্কের কাছে। একই দিনে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল ২২ বছরের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মেডলগকে।
এছাড়া চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)—যেখানে দেশের প্রায় অর্ধেক কনটেইনার হ্যান্ডেল হয়—এটিকেও সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড–এর হাতে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তবে হাইকোর্ট আপাতত চুক্তি-সম্পর্কিত পদক্ষেপ স্থগিত রেখেছে।
এনসিটি বর্তমানে ১৭ বছর ধরে দেশীয় প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেডের অধীনে লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি কেন বিতর্কিত

সরকার বলছে—আধুনিকতা, স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও দ্রুততার জন্য বিদেশি অপারেটর প্রয়োজন।
কিন্তু সমালোচকদের অভিযোগ—চুক্তির বিবরণ ‘নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট’-এর কারণে গোপন রাখা হয়েছে; জনগণের জানার অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

সমালোচনার মূল পয়েন্টগুলো হলো—

১. স্বচ্ছতার অভাব ও গোপন চুক্তি

চুক্তির আর্থিক শর্ত, চার্জ, ট্যারিফ, কর-বিধি—সরকার প্রকাশ করছে না।
এত বড় জাতীয় সম্পদের বিষয়ে গোপনীয়তা মানুষের মধ্যে সন্দেহ বাড়াচ্ছে।

২. জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন

চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র।
এখানে বিদেশি কর্তৃত্ব ভবিষ্যতে ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকিতে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
২০০৬ সালে নিরাপত্তাজনিত কারণে যুক্তরাষ্ট্র এরকম চুক্তি বাতিল করেছিল—এই উদাহরণও আবার সামনে এসেছে।

৩. শ্রমবাজারে চাকরি হারানোর ঝুঁকি

দেশীয় কর্মী, শ্রমিক, অপারেটর, জাহাজ এজেন্টসহ বহু মানুষ আশঙ্কা করছেন যে বিদেশি অপারেটর এলে অভিজ্ঞ দেশীয়দের চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে।

৪. দেশের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদেশিদের দেওয়া হচ্ছে কেন?

এনসিটি দেশীয় ব্যবস্থাপনায় প্রতি বছর ১ হাজার ২ শত কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আনে, আর লাভ হয় ৫ শত কোটি টাকার বেশি।
এমন লাভজনক জায়গাও কেন বিদেশিদের কাছে যাবে—এ প্রশ্ন তুলছে সাধারণ মানুষ থেকে অর্থনীতিবিদ পর্যন্ত।

৫. সাধারণ মানুষের ওপর ব্যয় বাড়ার শঙ্কা

বিদেশি অপারেটরের লাভ নিশ্চিত করতে মাশুল বাড়ানো হলে আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে।
রপ্তানিও ব্যয়বহুল হয়ে যাবে—যা পোশাক খাতসহ সব শিল্পে প্রভাব ফেলবে।

সরকারের যুক্তি

সরকার বলছে—

  • আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে বন্দরের গড় সময় (বর্তমানে ৭–১০ দিন) কমে ২–৩ দিনে নামবে।

  • কোনো সরকারি খরচ ছাড়াই বিদেশি বিনিয়োগে অবকাঠামো উন্নয়ন হবে।

  • সাইনিং মানি ও কনটেইনার চার্জ থেকে সরকার উল্লেখযোগ্য রাজস্ব পাবে।

সমালোচকদের পাল্টা যুক্তি

  • বন্দর শুধু অর্থনীতি নয়, কৌশলগত জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়।

  • দুর্নীতি ও জটিলতাই বন্দরকে অদক্ষ রেখেছে—এগুলো সংস্কার করলে বিদেশি অপারেটর ছাড়াই দক্ষতা বাড়ানো যেত।

  • বন্দর ব্যবস্থাপনার মূল সমস্যা কাস্টমসে জটিলতা, লজিস্টিক সীমাবদ্ধতা, নাব্যতা সংকট—যা বিদেশি অপারেটর সমাধান করতে পারবে না।

বিকল্প প্রস্তাবনা

চুক্তির বিরোধীরা বলছেন—

  • খোলা প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

  • কাস্টমস সংস্কার, কানেকটিভিটি ও লজিস্টিক উন্নয়ন করাই মূল সমাধান।

  • বিদেশি প্রতিষ্ঠান পরামর্শদাতা হতে পারে—কিন্তু নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রীয় সংস্থার হাতে থাকা উচিত।

মানুষের মনোভাব ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা

বন্দরকে ঘিরে লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা।
বন্দরেই গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক কাঠামো দেশের আমদানি-রপ্তানির ৯০% বহন করে।
এই গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো বিদেশিদের হাতে গেলে অনেকেই মনে করছেন—

“এটি শুধু একটি চুক্তি নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ভবিষ্যৎ।”

সরকার দৃঢ় অবস্থানে বলছে—এই চুক্তি দেশকে এগিয়ে নেবে।
অন্যদিকে সমালোচকদের বক্তব্য—এটি ভবিষ্যতে বড় ধরনের মূল্য দিতে হতে পারে।
তবে মানুষের প্রত্যাশা—যে পথেই যাওয়া হোক, যেন দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ, নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/7127 ,   Print Date & Time: Tuesday, 25 November 2025, 06:18:42 PM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh