
বছরের পর বছর লাভজনক অবস্থানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন (আইসিবি) এখন বড় লোকসানে ডুবে গেছে। পরিস্থিতি এমন যে প্রতিষ্ঠানটির টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ, অতি মূল্যের শেয়ারে বিনিয়োগ এবং শেয়ারের মূল্যে পতনই প্রতিষ্ঠানটিকে এই সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে আইসিবি রেকর্ড ১,২১৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেও প্রতিষ্ঠানটির লোকসান ১৫১ কোটি টাকা। পাশাপাশি, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার বিনিয়োগে আনরিয়ালাইজড লস বা ফান্ড ইরোশন ৫,০০০ কোটি টাকারও বেশি।
ফান্ড ইরোশন বলতে বোঝায় শেয়ারের ক্রয়মূল্য থেকে বর্তমান বাজারমূল্য কমে যাওয়া, যা এখন বিক্রি করলে লোকসান হবে।
আইসিবির কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখা কঠিন। চেয়ারম্যান আবু আহমেদ টিবিএসকে বলেন, “বিগত সময়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ভেস্টেড গ্রুপের স্বার্থে উচ্চমূল্যে শেয়ার কেনা হয়েছে। বর্তমানে ওই শেয়ারের বাজারমূল্য ক্রয়মূল্যের তুলনায় অনেক কম। বাজারের গ্যাম্বলাররা আইসিবির কাছে শেয়ার ‘পাম্প অ্যান্ড ডাম্প’ করেছে।”
আইসিবি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার সীমাও অতিক্রম করেছে। ফলে সোনালী ব্যাংক আইসিবিকে ৩৭৫ কোটি টাকা ফেরত দিতে চিঠি দিয়েছে, যা পরবর্তীতে শেয়ার বিক্রি করে ফেরত দেওয়া হয়।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক নীরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ টিবিএসকে জানান, বিনিয়োগের বিপরীতে প্রভিশন বৃদ্ধি, পোর্টফোলিওতে ইরোশন এবং ঋণের উচ্চ সুদ ব্যয় বৃদ্ধির কারণে লোকসান হয়েছে। চলতি মাসে ঋণের সুদ পরিশোধে প্রতিমাসে খরচ ৯০ কোটি টাকা।
লোকসানের উদাহরণ:
- রেনেটা ওষুধ কোম্পানি: আইসিবি বিনিয়োগ ৯০০ কোটি টাকা, সর্বোচ্চ ক্রয়মূল্য ১,৪৮০ টাকা, বর্তমান বাজারমূল্য ৩৮৯ টাকা। লোকসান ৫২১ কোটি টাকা।
- ইফাদ অটোস: ২০১৪ সালে ২৬৫ কোটি টাকায় শেয়ার কেনা, বর্তমান বাজারমূল্য ১৯.২০ টাকা। লোকসান ২১১ কোটি টাকা।
ফান্ড ইরোশনের বড় অংশ ২০১৫-২০১৭ সালে কেনা শেয়ারে। পাশাপাশি, প্রায় ১,০০০ কোটি টাকার এফডিআরও ফেরত পাওয়া যায়নি।
ঋণের বোঝা:
২০১৫-২০ সালের মধ্যে আইসিবির ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫,৭৩৪ কোটি থেকে ১৩,৪৫৬ কোটি টাকা। এর ফলে আয়ের ৯৪ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে।
আইসিবি বর্তমানে সরকারের কাছে ১৩,০০০ কোটি টাকার সহায়তা চেয়েছে। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৩,০০০ কোটি টাকা পেয়েছে, যার ২,০০০ কোটি টাকা উচ্চ সুদের ঋণ পরিশোধে ব্যবহার হয়েছে।
অভিযোগ:
আইসিবির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ ও পোর্টফোলিও বিভাগের কর্মকর্তাদের যথাযথ যাচাই-বাছাই না করে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ ও উচ্চ মূল্যের শেয়ার কেনা মূল সংকটের কারণ। বিশেষ করে ২০১৬-১৭ সালের সময়ে পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক হাবীবুর রহমানের সময়ে প্রায় ২,৯০০ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়েছিল, যা বর্তমানে ১,৩০০ কোটি টাকায় নেমেছে। কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত স্বার্থে উচ্চমূল্যে শেয়ার কেনার অভিযোগও আছে, যার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খতিয়ে দেখছে।
সংক্ষেপে, ধারাবাহিকভাবে লাভজনক থাকা আইসিবি এখন ঋণের বোঝা, ফান্ড ইরোশন ও উচ্চ মূল্যের শেয়ার বিনিয়োগের কারণে বিপুল লোকসানের মুখে।