![]()
দেশের সর্বোচ্চ আদালত, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে—নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে পুনর্বহাল করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট আইনকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেছেন।
২০১১ সালে আপিল বিভাগই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিল। সেই রায় দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক এবং সমাজ-আইনি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এবার সেই সিদ্ধান্তকে আপিল বিভাগ “অবৈধ” ঘোষণা করেছে এবং ত্রয়োদশ সংবিধান সংশোধনীর বিধানকে পুনরায় সক্রিয় করেছে।
তবে এই পুনরুজ্জীবন সম্বন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত দেওয়া হয়েছে: রায়ে বলা হয়েছে যে আগামী ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই ব্যবস্থা কার্যকর হবে না। অর্থাৎ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুর্নগতি পুরোপুরি প্রয়োগ শুরু হবে চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে।
রায়ের বৈধতা ও প্রভাব
বেঞ্চে উপস্থিত অন্য বিচারপতিগুলোর মধ্যে ছিলেন: আদালতের বিচারপতি মোঃ আশফাকুল ইসলাম, জুবায়ের রহমান চৌধুরী, মোঃ রেজাউল হক, এস এম ইমদাদুল হক, এ কে এম আসাদুজ্জামান ও ফারাহ মাহবুব।
রায়ে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের সেই সিদ্ধান্তে পুঙ্খানুপুঙ্খ রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ত্রুটি ছিল এবং সেই ভুল শুধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে আবার সক্রিয় করা হলো। বিচার বিভাগ রায়ের ক্ষেত্রে “প্রসপেক্টিভ ইফেক্ট” নির্দেশ দিয়েছে — অর্থাৎ এই রায়ে অতীতের নির্বাচনের গঠিত সংসদকে বাতিল করার কথা বলা হয়নি, তবে ভবিষ্যতের জন্য এটি প্রভাব বিস্তার করবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেছেন, এই রায়ের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্রকে নতুনভাবে গঠন করার একটি সুযোগ এসেছে। তিনি বলেন,
“আপনার ভোট আপনার হাতে — দিনের ভোট রাতে হবে না, মৃত ভোটার আস্তানা থাকবে না। এই রায়ের মাধ্যমে আমরা গণতান্ত্রিক মহাসড়কে নতুন করে হাঁটতে শুরু করছি।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
-
বিএনপি ও দলের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল রায়ের প্রশংসা করেছেন। তার মতে, ২০১১ সালের রায়ের ভুল সংশোধন করাসহ সংবিধানগতভাবে নির্বাচনের সর্বোচ্চ ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করল আদালত।
-
জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলছেন, রায়ে স্পষ্ট করা হয়েছে যে ভবিষ্যতে সংসদ ভেঙে ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে।
-
ড. বদিউল আলম মজুমদার এবং সুজন অন্যান্য নাগরিকরা যে রিভিউ আবেদন করেছিলেন, তাদের পক্ষ থেকে এই রায়কে গণতন্ত্র ও নির্বাচনী স্বচ্ছতার জন্য একটি বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস
-
ইতিহাস বলছে, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন রাজনৈতিক সংকটে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল।
-
২০১১-এ আদালত বিলুপ্তি ঘোষণা করেছিল, কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক উত্তাপ ও নাগরিক দাবির কারণে এই সিদ্ধান্ত আবার পরীক্ষা করা হয়।
-
গত বছরের ৫ আগস্ট, বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক এবং রাজনৈতিক দল এই রায়ে রিভিউ আবেদন করেন।
-
এপ্রিল-মে মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক প্রভাব, অর্থনীতি ও নির্বাচন-প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে দেশজুড়ে রাজনৈতিক আলোচনা নতুন মাত্রা পায়।
মানবরূপ এবং গণতান্ত্রিক গুরুত্ব
এই রায় একটি মানবিক এবং গণতান্ত্রিক অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে। সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে ভোটাররা দীর্ঘদিন ধরে নিজের ভোট দেওয়ার অধিকার, স্বচ্ছ নির্বাচন পদ্ধতি, এবং নিরপেক্ষ প্রশাসনের নিশ্চয়তা দাবি করে আসছিলেন। আদালতের এই সিদ্ধান্ত সেই দাবি পূরণের দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
এছাড়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ভবিষ্যতে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু করার সম্ভাবনাও বাড়ায়। এটি শুধু রাজনৈতিক ফর্মালিটি নয়; এটি মানুষের বিশ্বাস ও সম্ভাবনার এক নতুন অধ্যায়।