![]()
গত দেড় দশকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের শাসনামলের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ। এর মধ্যে অন্যতম জনতা ব্যাংক পিএলসি, যেখানে বিতরণকৃত ঋণের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ খেলাপি হিসেবে রয়ে গেছে। নগদ তহবিলের তীব্র সংকটে থাকা এই ব্যাংক গত বছরই ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি নিট লোকসান গুনেছে। ঋণ প্রদানের মতো পরিস্থিতি না থাকার কারণে ব্যাংকের ১৪ হাজারের বেশি কর্মীর অনেকেরই কার্যক্রম সীমিত, কেবল দৈনন্দিন লেনদেন বা আমানত সংগ্রহের কাজ করছেন।
সদৃশভাবে, ২০০৯ সালের পর থেকে বেসিক ব্যাংকও ৫ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। খেলাপি ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ থাকায় এখানে কাজের সুযোগ সীমিত, এবং দুই হাজারেরও বেশি কর্মীর মধ্যে বড় অংশের কার্যক্রম নেই।
বর্তমানে সরকারের মালিকানাধীন ৯টি তফসিলি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে, আর বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে কাজ করে। তফসিলি ব্যাংক ছাড়াও আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক তফসিল-বহির্ভূত ব্যাংক হিসেবে আছে। এই সব ব্যাংকে প্রায় ৮০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। বিপুল খেলাপি ঋণ, মূলধন ও সঞ্চিতির ঘাটতি, তারল্য সংকট ও ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে ব্যাংকগুলোর অধিকাংশই সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে।
পল্লবী ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যক্রম—সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ, সঞ্চয়পত্র বিক্রি, সরকারি চালান আদায়, আমদানির এলসি খোলা—বর্তমানে অনলাইনে এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে হচ্ছে। এছাড়া সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প স্থবির হওয়ায় ঋণ বিতরণও প্রায় বন্ধ। ফলে ব্যাংকের কর্মীদের বড় অংশের হাতে কার্যক্রম নেই। সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীর মতে, এই অবস্থায় সরকারের সব ব্যাংক রাখার প্রয়োজন নেই; সোনালীসহ দুই-তিনটি ব্যাংক যথেষ্ট।
২০০৭ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা ও সরকারের মালিকানা ধীরে ধীরে কমানো, কিন্তু রূপালী ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যাংকই তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। ফলে ব্যাংকগুলোর সংস্কারে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন এখনও অপরিপূর্ণ রয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সংস্কার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন, যেমন ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে গত এক বছরে তেমন কোনো সংস্কার দেখা যায়নি। এ ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডি নিয়োগ করা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মাধ্যমে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন শেষে প্রধান চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক—সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী—এর বিতরণকৃত ঋণের ৪৮.১০ শতাংশ খেলাপি। জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭৫.৯১ শতাংশ, বেসিক ব্যাংকের ৬৯.২০ শতাংশ, আর বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৪২.১০ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোরও অবস্থার চিত্র উদ্বেগজনক; বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঋণ খেলাপি ৪৯.৪৪ শতাংশ, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ২২ শতাংশ।
সোনালী ব্যাংক সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হলেও ঋণ স্থিতি কমে গেছে, এডিআর মাত্র ৫৭ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ৭২ হাজার কোটি টাকায় আটকে, যার প্রায় ৪১ শতাংশ খেলাপি। রূপালী ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ৪৬ হাজার ৫২১ কোটি টাকা, খেলাপি ৪৪ শতাংশ। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক এবং কৃষি ব্যাংকও কাঙ্ক্ষিত উন্নতি করতে পারেনি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন কার্যক্রম কম থাকায় অনেক কর্মকর্তা শুধু বেতন নিয়ে ব্যাংকে বসে সময় কাটাচ্ছেন। জনতা ব্যাংকের এমডি মজিবর রহমান বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার সময় আমি একটি বিধ্বস্ত ব্যাংক পেয়েছি। ব্যাংককে পুনর্গঠন করার চেষ্টা করছি, তবে ঋণ বিতরণ আর সম্ভব হচ্ছে না।’ অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদও জানিয়েছেন, ব্যাংকের বর্তমান সংকট কল্পনার বাইরে, এবং অতীতের দীর্ঘকালীন লুটপাট ও অনিয়ম ব্যাংককে সংকটাপন্ন করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম ও ঋণ বিতরণ সীমিত হওয়ায় কর্মীদের হাতে কাজ নেই, আর সংস্কারের অভাবের কারণে এই ব্যাংকগুলোর আর্থিক ও প্রশাসনিক দুরবস্থা অব্যাহত রয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কারের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংকগুলোর সংস্কার কার্যক্রম আগামী দুই-তিন মাসে এগোবে।