![]()
গাজা উপত্যকার ধ্বংসস্তূপে আজ শুধু মাটি নয়—মানুষের স্বপ্ন, শিশুর অশ্রু আর একটি জাতির বেঁচে থাকার সংগ্রাম স্তূপ হয়ে আছে।
প্রায় দুই বছর ধরে চলমান ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন ৬৯ হাজারের বেশি মানুষ, যাদের অধিকাংশই শিশু, নারী ও বয়স্ক। বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়গুলোর একটি আজ গাজার বুকে জন্ম নিয়েছে, যেখানে প্রতিটি বাড়ির ভাঙা দেয়ালে লেগে আছে আর্তচিৎকারের দগদগে চিহ্ন।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজা উপত্যকা ক্রমাগত অবরোধ, ক্ষুধা, বোমা ও মৃত্যুতে ঘেরা। হাসপাতাল ভেঙে গেছে, স্কুল মাটির সাথে মিশেছে, আশ্রয়কেন্দ্রও আর নিরাপদ নয়। প্রতিটি দিন মানুষের জীবনের সংখ্যা কমলেও বাড়ছে অনিশ্চয়তা ও শোকের ভার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র—ইসরায়েলের সবচেয়ে দৃঢ় মিত্র
ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের সামরিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ শুরুর পর থেকে শুধু চুক্তিবদ্ধ সহায়তাই নয়, অতিরিক্ত ২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি সামরিক সহায়তা প্রদান করেছে।
এই অস্ত্রগুলো নিয়েই গাজায় পরিচালিত হয়েছে নির্বিচার বিমান হামলা, আর্টিলারি ফায়ার এবং স্থল অভিযানের নামে সাধারণ মানুষের ওপর অমানবিক গণহত্যা।
মার্কিন সিস্টেমের অভ্যন্তরে এ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের হলেও এবার প্রথমবারের মতো কংগ্রেসে তোলা হয়েছে আনুষ্ঠানিক ‘গণহত্যা স্বীকৃতি প্রস্তাবনা’।
কংগ্রেসে গণহত্যার স্বীকৃতি—রাশিদা তায়েবের ঐতিহাসিক উদ্যোগ
ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত মার্কিন কংগ্রেসউওম্যান রাশিদা তায়েব গত শুক্রবার গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতির জন্য একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছেন।
তার আহ্বানে ইতোমধ্যে সমর্থন জানিয়েছেন অন্তত ২০ জন ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতা।
শুধু প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাট নয়—প্রস্তাবনার প্রতি সমর্থন দিয়েছেন রিপাবলিকান মারজোরি টেইলর গ্রিন এবং স্বতন্ত্র সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সও।
এটি আমেরিকার দীর্ঘদিনের দ্বিপক্ষীয় ইসরায়েল সমর্থন নীতির বিরুদ্ধে এক বিরল মানবিক প্রতিরোধ।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রস্তাবটিতে সমর্থন দিয়েছেন:
-
আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ
-
রো খান্না
-
ম্যাক্সওয়েল আলেজান্দ্রো ফ্রস্ট
তাদের মতে, গাজায় যা ঘটছে তা যুদ্ধ নয়—“government-enabled mass killing”, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সহায়তায় সংঘটিত গণহত্যা।
রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ কংগ্রেস—প্রস্তাব পাসের সম্ভাবনা কম, কিন্তু প্রভাব বিশাল
যদিও কংগ্রেসের বর্তমান ক্ষমতার ভারসাম্য প্রস্তাবটি পাসের সম্ভাবনাকে খুবই কমিয়েছে, তবুও এই প্রস্তাব গাজা যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন সমাজ ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিবর্তনকে সামনে এনেছে।
এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে—
ইসরায়েল এখন আগের মতো অন্ধ সমর্থন আর পাচ্ছে না।
প্রস্তাবটি পাস হলে যা ঘটবে:
-
যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে গাজা গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেবে
-
ইসরায়েলে সামরিক সহায়তা পাঠানো বন্ধ হবে
-
মার্কিন অস্ত্র কীভাবে গণহত্যায় ব্যবহৃত হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে
-
ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞার পথ খুলবে
গাজার মানবিক বিপর্যয়—ক্ষুধা, অবরোধ ও মৃত্যু
ইসরায়েল শুধু যুদ্ধই করেনি—গাজাকে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে মানবিক সহায়তা ঢোকা প্রায় অসম্ভব করে দিয়েছে। খাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম, জ্বালানি—কিছুই মিলছে না পর্যাপ্ত পরিমাণে।
এর ফলে গাজা উপত্যকায় মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘ বারবার “মানবসৃষ্ট দুর্যোগ” হিসেবে উল্লেখ করেছে।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আংশিক যুদ্ধবিরতি হলেও, ইসরায়েল অবরোধ তুলে নেয়নি। খাদ্যপণ্যের চালান আটকে রাখা, সীমান্ত বন্ধ রাখা এবং মাঝে মধ্যেই হামলা চালানো—এই সব মিলিয়ে যুদ্ধবিরতি বাস্তবে কার্যকর হয়নি।
রাশিদা তায়েব বলেন:
“যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে—এটাই গণহত্যা।”
গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এবং ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন বি’টসেলেম তাদের তদন্তে স্পষ্টভাবে বলেছে—
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান গণহত্যার আইনি সংজ্ঞায় পড়ে।
এমনকি ইসরায়েলের নিজস্ব মানবাধিকার সংগঠনও স্বীকার করেছে যে এটি কেবল যুদ্ধ নয়—রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্দীপিত গণহত্যা।
সমাপ্তি: মানবিক বিশ্ব কি গাজাকে দেখবে?
বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ, কংগ্রেসে বিতর্ক, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের আওয়াজ—সব মিলিয়ে গাজা আজ কেবল মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্র নয়, মানবতার পরীক্ষা।
৬৯ হাজার মৃত্যুর পেছনে রয়েছে লাখো মানুষের অশ্রু, তীব্র ক্ষুধা, ঘরহারা পরিবার, আর এমন শিশুরা—যাদের চোখেও এখন যুদ্ধের ভয়, না পাওয়া খাবারের বেদনা, আর হারানো পরিবারের শোক।
বিশ্ব কি তাদের দিকে তাকাবে?
গণহত্যার স্বীকৃতি কি থামাতে পারবে এই মৃত্যুপরিবেশ?
মার্কিন রাজনীতির এই পরিবর্তন কি সত্যিই গাজার মানুষের বাঁচার সুযোগ তৈরি করবে?
উত্তর সময়ের হাতে, কিন্তু ইতিহাস সেই মুহূর্তের অপেক্ষায়।