![]()
ন্যায়বিচারের প্রতীক্ষা— রাষ্ট্র বনাম প্রভাবশালী আসামি
বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের দিকে তাকিয়ে আছে দেশ।
চব্বিশের জুলাই–আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে আজ বৃহস্পতিবার রায়ের তারিখ ঘোষণা করবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
রায়ের দিন ঘোষণার আগেই ট্রাইব্যুনাল চত্বরকে ঘিরে নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী এবং সাদা পোশাকের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে সেগুনবাগিচায়। প্রবেশপথে কড়া তল্লাশি চলছে, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ সীমিতভাবে প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছেন।
এ যেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময়কার সেই টানটান পরিবেশের পুনরাবৃত্তি।
বিচারালয়ের ভেতরে নীরব উত্তেজনা
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে ট্রাইব্যুনাল–১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের প্যানেল রায়ের তারিখ ঘোষণা করবেন।
অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
রায়ের আগে ট্রাইব্যুনাল চত্বরের প্রতিটি প্রবেশমুখ, পার্শ্ব সড়ক এবং সংলগ্ন ভবনে নিরাপত্তা বাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরায় পুরো এলাকা নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য: ‘আইনের চোখে কেউ অমর নয়’
গত ২৩ অক্টোবর সমাপনী বক্তব্যে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ট্রাইব্যুনালে বলেন,
“বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। বাংলাদেশও সেই ন্যায়ের পথেই হাঁটছে।”
তিনি শেখ হাসিনা ও কামালের সর্বোচ্চ দণ্ড দাবি করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আরও বলেন,
“এ মামলাটি শুধু দুইজন ব্যক্তির নয়— এটি সেইসব মানুষের রক্ত-চিহ্নিত স্মৃতি, যারা ন্যায়বিচারের স্বপ্ন দেখেছিলেন।”
অন্যদিকে রাষ্ট্রনিযুক্ত ডিফেন্স কাউন্সেল আমির হোসেন পাল্টা যুক্তিতে বলেন,
“রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নামে যেন ইতিহাস বিকৃত না হয়।”
এরপর দীর্ঘ শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল আজকের তারিখ ঘোষণা করে।
অভিযোগের প্রকৃতি ও পরিসর
মামলাটিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে—
১️আন্দোলনে উসকানি ও পরিকল্পনা
২️মারণাস্ত্র ব্যবহার
৩️আবু সাঈদ হত্যা
৪️চানখারপুলে হত্যা
৫️আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানো
অভিযোগপত্রের পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮,৭৪৭।
এর মধ্যে—
-
তথ্যসূত্র: ২,০১৮ পৃষ্ঠা
-
জব্দতালিকা ও প্রমাণাদি: ৪,০০৫ পৃষ্ঠা
-
শহীদদের তালিকা: ২,৭২৪ পৃষ্ঠা
মোট ৮৪ জন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
মানবিক বাস্তবতা: ন্যায়বিচারের চেয়ে বড় মানবাধিকার নেই
এই মামলাকে কেন্দ্র করে সমাজে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে—
ন্যায়বিচার কি বিলম্বিত হলে নষ্ট হয়?
ক্ষমতাবানদের বিচারের মানদণ্ড কি সাধারণের মতোই?
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার মানেই রাষ্ট্রের নৈতিক শক্তির প্রকাশ।
জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণায়ও বলা আছে—
“Where justice is denied, humanity bleeds.”
বাংলাদেশের জন্য এই রায় তাই শুধু আইন নয়, মানবতারও পরীক্ষা।
প্রেক্ষাপট ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
২০২৪ সালের জুলাই–আগস্ট আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনায় বহু মানুষ নিহত হন।
রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ করে, তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশে সহিংস কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
এমন অভিযোগের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা গত মে মাসে প্রতিবেদন জমা দেয়।
এর আগে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় যেমন দেশজুড়ে আলোড়ন উঠেছিল, এবারও অনেকে বলছেন—
“এ রায় হবে ন্যায়বিচারের নতুন সংজ্ঞা।”
মানুষের মুখে একটি প্রশ্ন
বিচারের কাঠগড়ায় যখন প্রভাবশালী রাজনীতিকদের নাম উঠে আসে, তখন সাধারণ মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেউ বলে, ‘এটাই ন্যায়বিচার’; আবার কেউ ভয় পায় রাজনৈতিক প্রতিশোধের।
কিন্তু সত্যি কথা হলো— মানবতাবিরোধী অপরাধ কখনো সময়ের ছায়ায় ঢাকা পড়ে না।
এই রায় হয়তো সেই বিশ্বাসকেই পুনঃস্থাপন করবে।
শেষ কথা
আজকের দিনটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ও মানবিক ইতিহাসের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
রায়ের পর যাই হোক না কেন— ন্যায়বিচারের পথচলায় এক নতুন অধ্যায় যুক্ত হবে।
“বিচার বিলম্বিত হতে পারে, কিন্তু অস্বীকার করা যায় না।”
— আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতিমালা