• হোম > শিক্ষা > স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও অবহেলিত শিক্ষা

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও অবহেলিত শিক্ষা

  • সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৫৯
  • ৫৪

---

বিশ্বজুড়ে যে দেশগুলো আজ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মডেল হয়ে উঠেছে—তাদের সবার প্রথম বিনিয়োগ ছিল শিক্ষায়। শিক্ষা ছিল উন্নয়নের ভিত্তি, অগ্রগতির হাতিয়ার। কিন্তু বাংলাদেশে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনকাল ছিল অবকাঠামোগত প্রকল্পে পরিপূর্ণ—নতুন ভবন, আধুনিক ক্লাসরুম, বিপুল বাজেট—কিন্তু শেখার মানে ছিল ভয়াবহ অবনমন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের মানুষ নতুন আশায় বুক বাঁধে। শিক্ষাঙ্গন থেকেই শুরু হয়েছিল সেই আন্দোলন। তাই সবার প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাকে পুনর্গঠনের প্রথম অগ্রাধিকার দেবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল তার উল্টোটা। প্রশাসন, অর্থনীতি, নির্বাচনসহ ১১টি খাতে সংস্কার কমিশন গঠন হলেও শিক্ষার জন্য কোনো কমিশনই হয়নি।


শিক্ষার মানে ধস, অথচ প্রকল্পে বিপুল ব্যয়

স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষার মান ক্রমেই কমেছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে এই অবনমন পৌঁছায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের নামে দুটি বৃহৎ প্রকল্পে ব্যয় হয় প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা, অথচ জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়নে দেখা যায়, বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানে দক্ষতা কমেছে। শিক্ষাবিদদের মতে, শেখার চেয়ে ভবন নির্মাণ ও প্রশাসনিক প্রদর্শনিতেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

একজন শিক্ষক গড়ে ৫০–৬০ শিক্ষার্থী সামলান, অথচ নিয়মিত প্রশিক্ষণ নেই। ব্যানবেইসের তথ্যমতে, প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষক আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞ। বিশেষ করে গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতে শেখার পরিবেশ অত্যন্ত দুর্বল।


“গণ–অভ্যুত্থানের আঁতুড়ঘর ছিল শিক্ষাঙ্গন”—তবু উপেক্ষিত শিক্ষা

গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন,

“গণ–অভ্যুত্থানের প্রাণ ছিল শিক্ষার্থীরা। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষা সংস্কারে কোনো কমিশন গঠন করল না। দেশ পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষা বাদ দিয়ে কীভাবে পুনর্গঠন সম্ভব?”

তিনি মনে করেন, শিক্ষার কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া দেশ এগোতে পারে না। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত মানোন্নয়ন নিশ্চিত করা ছাড়া উন্নয়ন কথার ফুলঝুরি হয়ে থাকে।


মাধ্যমিকে ভয়াবহ চিত্র: ৪১ শতাংশ অকৃতকার্য

চলতি বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল শিক্ষার বাস্তবতা স্পষ্ট করেছে। মাধ্যমিকে ৩১.৫৫% এবং উচ্চমাধ্যমিকে ৪১.১৭% শিক্ষার্থী অকৃতকার্য। সরকার দাবি করছে, ফলের মান উন্নয়নে কৃত্রিম নম্বর বাড়ানো হয়নি। কিন্তু শিক্ষাবিদদের মতে, এ ব্যর্থতা শিক্ষকদের দক্ষতার অভাব, মানহীন পাঠ্যবই, এবং দুর্বল মূল্যায়ন ব্যবস্থার প্রতিফলন।

বিশ্বব্যাংকের হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্স দেখায়, বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ১০ বছর স্কুলে পড়ে আন্তর্জাতিক মানে মাত্র ৬ বছরের দক্ষতা অর্জন করে—যা ২০১৭ সালের তুলনায় আরও কমেছে।


“শিক্ষা রাজনৈতিক হাতিয়ার, উন্নয়নের নয়”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম বলেন,

“শিক্ষায় সব সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রাধান্য পেয়েছে। মানোন্নয়ন, দক্ষ শিক্ষক বা কার্যকর কারিকুলাম—এসব কোনো সময়ই অগ্রাধিকার পায়নি।”

তিনি আরো বলেন, জুলাই–পরবর্তী সংস্কার প্রক্রিয়ায়ও শিক্ষা বাদ পড়েছে। ঐকমত্য কমিশনে শিক্ষার আলোচনা না হওয়ায় বাস্তব কোনো নীতিগত পরিবর্তন আসেনি।


উচ্চশিক্ষায় রাজনীতির ছায়া

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা কার্যক্রম প্রায় অদৃশ্য। একাডেমিক কাজের বদলে রাজনীতি, প্রশাসনিক পদ দখল ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত শিক্ষকদের কারণে গবেষণার মান ধসেছে। আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতন তার বাস্তব প্রতিফলন।


শিক্ষা এখনো মৌলিক অধিকার নয়

সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রকে গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, শিক্ষা মৌলিক অধিকারের তালিকায় নেই। ফলে নাগরিকেরা এর বাস্তব প্রয়োগ দাবি করতে পারেন না। প্রাথমিক স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু—যা সমাজে বৈষম্য বাড়াচ্ছে।


“জুলাই সনদে শিক্ষা সংস্কারের অনুপস্থিতি অস্বাভাবিক”

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন,

“গণ–অভ্যুত্থান হয়েছিল কোটা সংস্কার ও কর্মসংস্থানের দাবিতে। আর কর্মসংস্থানের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু শিক্ষা কমিশনই হয়নি—এটি রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার পরিচয়।”

তিনি মনে করেন, রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশাসন—এই তিনটি খাতকে সমান গুরুত্ব না দিলে দীর্ঘমেয়াদে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে না।


শিক্ষা–সংস্কারের দাবি: সময়ের অনিবার্য আহ্বান

বাংলাদেশ আজ তরুণ প্রজন্মের দেশ। তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একটি মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। অবকাঠামোর চেয়ে বেশি প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক, বাস্তবভিত্তিক পাঠ্যসূচি এবং রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন।
যে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের মশাল তুলে ধরেছিল, তাদের স্বপ্ন পূরণ হবে কেবল তখনই—যখন রাষ্ট্র বুঝবে শিক্ষা সংস্কারই টেকসই উন্নয়নের একমাত্র পথ।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/6569 ,   Print Date & Time: Thursday, 27 November 2025, 08:35:05 AM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh