রাশিয়ায় ভালো বেতন ও নিরাপদ চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশিদের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। অনেকে ভেবেছিলেন বৈধভাবে কাজ করতে যাচ্ছেন, কিন্তু সেখানে পৌঁছে জোর করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হচ্ছে—এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের নতুন প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনের নাম— ‘Promises Written in Blood: How Legal Migration Turned into Forced Recruitment in the Russia–Ukraine War’। এটি তৈরি করা হয়েছে রাশিয়া থেকে বেঁচে ফেরা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সাক্ষ্য নিয়ে।
ব্র্যাক জানিয়েছে, অন্তত ১০ জন বাংলাদেশিকে প্রলোভনে ফেলে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকে মারা গেছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বৈধ ভিসায় গিয়ে বন্দী জীবন
ভুক্তভোগীরা সবাই বৈধ ভিসা, বৈধ চুক্তিপত্র এবং সরকারি বিমানবন্দর দিয়েই রাশিয়া গিয়েছিলেন। কেউ ভেবেছিলেন তেল কোম্পানিতে, কেউ নির্মাণ বা লজিস্টিকস সেক্টরে কাজ পাবেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাদের পাসপোর্ট ও ফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং জোর করে সামরিক প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানো হয়।
এরপর তাদের দিয়ে “স্বেচ্ছাসেবক চুক্তিপত্র” সই করিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়।
প্রলোভনের জালে মৃত্যু ফাঁদ
ঢাকার উত্তরার আফজাল হোসেন মেরাজ ২০২৩ সালের আগস্টে ওয়েল্ডার হিসেবে রাশিয়া যান। এক রিক্রুটিং এজেন্টকে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে মাসে ৭০ হাজার টাকার চাকরির আশায় রওনা দেন।
পরে এক দালাল তাকে যুদ্ধের প্রস্তাব দেয়— ২৬ লাখ টাকার সাইনিং বোনাস, মাসে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকার বেতন, আহত হলে ক্ষতিপূরণ এবং যুদ্ধ জিতলে নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি।
মেরাজ রাজি হলেও সেখানে গিয়ে বন্দী হন।
তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গোপনে ফোনে জানান, “যেকোনো সময় মারা যেতে পারি।”
উরুতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তিনি হাসপাতালে থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নেন এবং সেপ্টেম্বর মাসে দেশে ফেরেন।
তার বাবা আলী হোসেন বলেন,
“আমার ছেলে যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাওয়ার ভয় নিয়ে বেঁচেছিল। তারা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার ছেলেকে যুদ্ধে পাঠিয়েছে। জীবনের চেয়ে বড় কিছু নাই।”
নিখোঁজ ও নিহতদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে
বাগেরহাটের আয়ন মণ্ডল, কুমিল্লার অমিত বড়ুয়া এবং ময়মনসিংহের মোহসিন আহমেদসহ অনেকে এখনো নিখোঁজ।
কেউ ড্রোন হামলায় নিহত, কেউ আহত হয়েও আবার যুদ্ধে পাঠানো হয়েছেন।
মোস্তাফিজুর রহমান, সিআইডির মানবপাচার দমন বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন—
“গত দুই বছরে অন্তত ১০ জন বাংলাদেশিকে অবৈধভাবে রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে।
দুজন দেশে ফিরেছেন, চার-পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, বাকিরা নিখোঁজ।”
তিনি ধারণা দেন, ৩০ জনের বেশি বাংলাদেশি যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, যদিও এখনো কারও মৃতদেহ দেশে আনা যায়নি।
ব্র্যাকের সতর্কতা ও আহ্বান
ব্র্যাক জানিয়েছে, এই ঘটনা বাংলাদেশের অভিবাসন ব্যবস্থার বড় দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। বৈধ অভিবাসনের পথও পাচার ও জোর করে নিয়োগের মাধ্যমে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
সংস্থাটি সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে—
ভুক্তভোগীদের দ্রুত শনাক্ত ও উদ্ধার করতে,
পরিবারগুলোর জন্য আইনি ও মানসিক সহায়তা নিশ্চিত করতে,
এবং সারা দেশে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন,
“আমরা জানি না ঠিক কতজন বাংলাদেশি যুদ্ধক্ষেত্রে আছেন বা মারা গেছেন।
এখনই জাতীয় পর্যায়ে জরিপ ও প্রচারণা না চালালে আরও মানুষের জীবন যাবে।”
বিশ্লেষণ:
এই ঘটনা শুধু মানবপাচার নয়, বরং বৈধ অভিবাসন ব্যবস্থার ভেতরে লুকিয়ে থাকা বিপদের একটি ভয়াবহ উদাহরণ। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক রাজনীতির ছায়া ফেলেছে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমবাজারেও।
বাংলাদেশের জন্য এখনই দরকার আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বিত উদ্যোগ, যাতে কেউ প্রলোভনে পড়ে এমন ফাঁদে না পড়ে।