• হোম > বাংলাদেশ > ড. জাকির নায়েকের বাংলাদেশ সফর নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা

ড. জাকির নায়েকের বাংলাদেশ সফর নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা

  • সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:৩৯
  • ৫৩

---

বিশ্বখ্যাত ইসলামি বক্তা ড. জাকির নায়েক আগামী নভেম্বরের শেষ দিকে বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন—এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দেশ-বিদেশে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা।
অর্থপাচার ও ঘৃণামূলক বক্তব্যের অভিযোগে অভিযুক্ত এই বিতর্কিত ধর্মপ্রচারককে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো ও তার সমাবেশ আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে।


ঢাকা ও পিরোজপুরে অনুমতি, চট্টগ্রাম ও সিলেটে নিষেধাজ্ঞা

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা ও পিরোজপুরে জাকির নায়েকের সমাবেশ আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
তবে সুফি মতাদর্শের অনুসারী বেশি থাকার কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেটে প্রস্তাবিত অনুষ্ঠান অনুমোদন পায়নি।

এসবি কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা ও পিরোজপুর অঞ্চলে সুফিবাদ ও মাজারকেন্দ্রিক ধর্মীয় প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম, ফলে সেখানে জাকির নায়েকের মতাদর্শ নিয়ে ধর্মতাত্ত্বিক সংঘাতের আশঙ্কা কম।


ভারতের উদ্বেগ: “তিনি পলাতক আসামি”

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সফর নিয়ে আনুষ্ঠানিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
৩০ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন,

“জাকির নায়েক ভারতের পলাতক আসামি। আমরা আশা করি, তিনি যে দেশে যাবেন, সংশ্লিষ্ট দেশ আমাদের নিরাপত্তা উদ্বেগ বিবেচনায় রাখবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।”

এদিকে, ভারতের এই মন্তব্যের জবাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় যে তারা বিষয়টি “নোট করেছে”।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এস এম মাহবুবুল আলম বলেন,

“আমরা ভারতের বিবৃতি লক্ষ্য করেছি।”

তবে একই সঙ্গে তিনি ইঙ্গিতপূর্ণভাবে মন্তব্য করেন,

“ভারতসহ কোনো দেশই অন্য কোনো দেশের পলাতক বা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।”
এই মন্তব্য অনেকেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতের আশ্রয়ের প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করেছেন।


সরকারি অনুমতির অনিশ্চয়তা: পরস্পরবিরোধী তথ্য

ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, জাকির নায়েকের সফরের অনুমতি দেওয়া বা না দেওয়া বিষয়টি স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।

পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্যেও রয়েছে পরস্পরবিরোধিতা।
ডিএমপির উপকমিশনার তালেবুর রহমান জানান,

“আমাদের কাছে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি আসেনি, অনুমতিও দেওয়া হয়নি।”

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন,

“চলমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় আনুষ্ঠানিক অনুমোদন এখনো দেওয়া হয়নি।”

তবে স্পেশাল ব্রাঞ্চের এক কর্মকর্তা, নাম প্রকাশ না করার শর্তে, বলেন,

“সরকার তার ঢাকায় আগমনে আপত্তি করছে না। তিনি বিশ্বজুড়ে সফর করেন। ঢাকায় এলে কোনো সমস্যা দেখছি না।”

তিনি আরও বলেন,

“ভারতের অবস্থান ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু আমরা তাকে অতিথি হিসেবে দেখছি। বাংলাদেশ সবসময় অতিথিদের স্বাগত জানায়।”


সম্ভাব্য সফরসূচি: ঢাকা ও পিরোজপুরে অনুষ্ঠান

ইমিগ্রেশন পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২৬ নভেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জাকির নায়েকের আগমন সম্ভাব্য।
এরপর তিনি ঢাকায় আগারগাঁওয়ের কোনো কনভেনশন সেন্টারে একটি ইনডোর ইসলামিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন।
২৮ নভেম্বর পিরোজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হবে তার দ্বিতীয় সমাবেশ।

স্পার্ক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নামের একটি সংস্থা অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্বে রয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে,

“সরকারি অনুমতি ও আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হবে।”

তবে পিরোজপুর–১ আসনের প্রার্থী মাসুদ সাঈদী এই আয়োজনের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন,

“আমি তাকে আমন্ত্রণ জানাইনি, তিনিও আমাকে চেনেন না।”


পটভূমি: ২০১৬ সালের পর আবার আলোচনায়

২০১৬ সালের হলি আর্টিজান হামলার পর জাকির নায়েকের বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
তদন্তে উঠে এসেছিল—হামলাকারীরা তার বক্তব্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
তখন থেকেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রাখে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই নিষেধাজ্ঞা শিথিল হওয়ায় তার সফরের সম্ভাবনা তৈরি হয়, যা এখন নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।


আন্তর্জাতিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ

জাকির নায়েকের সমর্থকরা এই সফরকে “ইসলামি ঐক্যের ঐতিহাসিক মুহূর্ত” হিসেবে দেখছেন,
অন্যদিকে সমালোচকরা মনে করছেন, এটি ধর্মীয় বিভাজন ও কূটনৈতিক টানাপোড়েনের জন্ম দিতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, তার উপস্থিতি বাংলাদেশে ধর্মীয় সহনশীলতা, নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য নতুনভাবে পরীক্ষা করবে।
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, তারা আহ্বান জানাচ্ছেন—

“যে কোনো ধর্মীয় নেতা বা অতিথি যেন সমাজে শান্তি, সহনশীলতা ও মানবিকতার বার্তা দেন, বিভাজনের নয়।”


ভারত ত্যাগের পর নায়েকের অবস্থান

৬০ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইসলামি বক্তা জাকির নায়েক ২০১৬ সালে অর্থপাচার ও ঘৃণাত্মক বক্তব্যের মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর ভারত ত্যাগ করেন।
সেই বছরই তার পরিচালিত ‘পিস টিভি’ ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়।
এরপর তিনি মালয়েশিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পান, এবং ঘোষণা দেন—

“ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমি ভারতে ফিরব না।”


উপসংহার: কূটনীতি, ধর্ম ও মানবিক ভারসাম্যের চ্যালেঞ্জ

ড. জাকির নায়েকের সম্ভাব্য সফর শুধু ধর্মীয় ঘটনা নয়, এটি এখন বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও সামাজিক সহনশীলতার এক বড় পরীক্ষা।
সরকারের অনুমতি ও নিরাপত্তা বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত সফরটি বাস্তবায়িত হবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।
তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—এই বিতর্ক বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিপথে নতুন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/6261 ,   Print Date & Time: Wednesday, 26 November 2025, 09:22:46 AM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh