সাইবার নিরাপত্তা জোরদার, বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে সিমকার্ডের অপব্যবহার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। আজ (শুক্রবার) থেকে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে সর্বোচ্চ ১০টি সিমের বেশি ব্যবহার করা যাবে না বলে নির্দেশ জারি করেছে সংস্থাটি।
ফলে ১০টির বেশি সিম নিবন্ধিত রয়েছে—এমন গ্রাহকদের অতিরিক্ত সিম আজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিটিআরসি জানিয়েছে, এ প্রক্রিয়ায় প্রায় ৫০ লাখ সিমকার্ড বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
একজনের নামে সর্বাধিক ১০টি সিম, অতিরিক্তগুলো বাতিল
বিটিআরসি গত আগস্টেই এক নোটিশে জানায়—যাদের নামে ১০টির বেশি সিম রয়েছে, তারা ৩০ অক্টোবরের মধ্যে নিজ উদ্যোগে অতিরিক্ত সিম ডি-রেজিস্ট্রেশন বা মালিকানা পরিবর্তন করবেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা না করায় এখন অপারেটরদের মাধ্যমে জোরপূর্বক বাতিলের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
বিটিআরসির সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম মনিরুজ্জামান বলেন,
“আমরা তিন মাস সময় দিয়েছিলাম। যারা এখনো সাড়া দেননি, তাদের অতিরিক্ত সিম আজ থেকেই ডি-রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে।”
দেশে মোট নিবন্ধিত সিম ২৬ কোটি ৬৩ লাখ
বিটিআরসির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ২৬ কোটি ৬৩ লাখ নিবন্ধিত সিম রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৯ কোটি সক্রিয়, বাকি সিমগুলো নিবন্ধিত হলেও অচল বা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে।
২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের সক্রিয় মোবাইল গ্রাহক ১৮ কোটি ৭৯ লাখ ৭০ হাজার—
-
গ্রামীণফোন: ৮ কোটি ৫৯ লাখ
-
রবি আজিয়াটা: ৫ কোটি ৭৫ লাখ
-
বাংলালিংক: ৩ কোটি ৭৯ লাখ
-
টেলিটক: ৬৬ লাখ ৭০ হাজার
২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৮ কোটি ১৩ লাখ, ২০২২ সালে ১৮ কোটি ১৬ লাখ, ২০২৩ সালে ১৮ কোটি ৯৬ লাখ, আর ২০২৪ সালে ১৮ কোটি ৯৯ লাখ। অর্থাৎ গত এক দশকে সিম ব্যবহারকারী বেড়েছে সাড়ে পাঁচ কোটিরও বেশি।
বিশ্বে সিম ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান নবম
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা সিইআইসি (CEIC)-এর তথ্য অনুযায়ী, সক্রিয় সিম ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের নবম অবস্থানে রয়েছে।
প্রথমে রয়েছে চীন (১৬১ কোটি), এরপর ভারত (১৫১ কোটি), ইন্দোনেশিয়া (৩৮.৫৫ কোটি), যুক্তরাষ্ট্র (৩৮ কোটি), ব্রাজিল (২৮ কোটি), রাশিয়া (২৫.৬১ কোটি), পাকিস্তান (১৯.৬০ কোটি), এবং নাইজেরিয়া (১৯ কোটি)।
বাংলাদেশের পরেই রয়েছে জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া।
অপব্যবহার রোধে কঠোর নজরদারি
বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে দেশে প্রায় ৬৭ লাখ গ্রাহকের নামে ১০টির বেশি সিম ছিল। তিন মাসে প্রায় ১৫ লাখ গ্রাহক স্বেচ্ছায় সিম বাতিল করেছেন, তবে এখনো ৫০–৫৩ লাখ সিম সক্রিয় রয়েছে—যেগুলো আজ থেকে বাতিল প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে।
অপারেটরদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—এই অতিরিক্ত সিম তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তি একাধিক সিম ব্যবহার করে সাইবার অপরাধ, প্রতারণা বা নির্বাচনী অপতৎপরতায় জড়াতে না পারেন।
অতিরিক্ত সিম কেন?—কারণ ও বিশ্লেষণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে সিমের সংখ্যা এনআইডির তুলনায় দুই গুণেরও বেশি।
নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী দেশে এনআইডিধারী ১২ কোটি ৬৩ লাখ নাগরিক, কিন্তু সিম রয়েছে ২৬ কোটির বেশি।
বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, গ্রামীণ অঞ্চলের অনেক মানুষ নিজের অজান্তে এনআইডি ও বায়োমেট্রিক তথ্য ব্যবহার করে একাধিক সিম নিবন্ধিত করেছেন।
তাছাড়া ১৮ বছরের নিচের মোবাইল ব্যবহারকারী, বিভিন্ন অপরাধী চক্র, এমনকি অপারেটরদের অতিরিক্ত বিক্রয় প্রচারণা ও অফার নীতিও সিম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
নির্বাচনের আগে বাড়তি সতর্কতা
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার সাইবার নিরাপত্তা জোরদার ও ডিজিটাল যোগাযোগে অপব্যবহার রোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
বিটিআরসি জানায়, নির্বাচনী সময়কালে সন্দেহজনক নম্বর, ফেক কল, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো বা বিভ্রান্তিমূলক কার্যক্রমে ব্যবহৃত সিমের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।