দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন অবশেষে দীর্ঘ নয় মাস পর আগামীকাল শনিবার (১ নভেম্বর) থেকে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে।
তবে এবার আগের তুলনায় পর্যটন ব্যবস্থায় থাকছে কঠোরতা ও নিয়ন্ত্রণ—দ্বীপের নাজুক প্রতিবেশ, সামুদ্রিক প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সরকার জারি করেছে ১২ দফা নির্দেশনা।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সেন্টমার্টিনে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন বন্ধ করতে এবার নেওয়া হয়েছে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
পর্যটকদের জন্য কঠোর শর্ত
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শাহিদুল আলম বলেন,
“প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও সৌন্দর্য রক্ষায় এবার নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।”
তিনি জানান, এবার নিরাপত্তার কারণে টেকনাফ থেকে নয়, বরং কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করবে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপ-পরিচালক মহিবুল ইসলাম বলেন,
“প্রত্যেক পর্যটককে ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে টিকিট নিতে হবে, যেখানে থাকবে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড। কিউআর কোডবিহীন টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।”
সেন্টমার্টিনের পুনর্জন্ম: ফিরে আসছে প্রাণবৈচিত্র্য
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ মাস পর্যটক চলাচল বন্ধ থাকায় দ্বীপের সামুদ্রিক পরিবেশে এক ধরনের পুনর্জন্ম ঘটেছে।
সৈকতে শামুক-ঝিনুকের বৃদ্ধি, লাল কাঁকড়ার দৌড়ঝাঁপ, আর মা কাছিমের ডিম পাড়ার পরিবেশ ফিরেছে আগের মতো।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান,
“অবৈধ অবকাঠামো নির্মাণ ও বেপরোয়া পর্যটন সেন্টমার্টিনকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পর্যটন নিয়ন্ত্রণের এই উদ্যোগ দ্বীপটিকে আবার প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে।”
পরিবেশ সংগঠনের মত: ‘সীমিত পর্যটনই টেকসই সমাধান’
পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ইয়েস কক্সবাজারের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক বলেন,
“সীমিত পর্যটনই সেন্টমার্টিনকে বাঁচাতে পারে। দ্বীপটি আমাদের জাতীয় সম্পদ—এটি বাণিজ্য নয়, সংরক্ষণ হিসেবে দেখতে হবে।”
তিনি বলেন, সরকারের এই উদ্যোগ সময়োপযোগী ও টেকসই পর্যটনের আদর্শ মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যদি সকল পক্ষ নির্দেশনা মেনে চলে।
সরকারের ১২টি নির্দেশনা এক নজরে
সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সেন্টমার্টিনে ভ্রমণে পর্যটকদের মানতে হবে নিম্নলিখিত নির্দেশনাগুলো—
১️নভেম্বর মাসে শুধুমাত্র দিনের বেলা ভ্রমণ অনুমোদিত।
২️ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে রাত্রিযাপনের সুযোগ থাকবে।
৩️ফেব্রুয়ারি মাসে সম্পূর্ণভাবে পর্যটক প্রবেশ বন্ধ থাকবে।
৪️প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২,০০০ পর্যটক প্রবেশ করতে পারবেন।
৫️রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি বা বারবিকিউ আয়োজন নিষিদ্ধ।
৬️কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
৭️কাছিম, শামুক-ঝিনুক, প্রবালসহ যেকোনো জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।
৮️মোটরসাইকেল, সি-বাইকসহ যেকোনো মোটরচালিত যান চলাচল নিষিদ্ধ।
৯️নিষিদ্ধ পলিথিন বহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
১০একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
১️১️ব্যক্তিগত পানির ফ্লাস্ক ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
১️২️পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন যৌথভাবে নির্দেশনা বাস্তবায়ন তদারকি করবে।
জীববৈচিত্র্যের আধার সেন্টমার্টিন
পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, প্রবাল, শৈবাল, কাছিম, সামুদ্রিক মাছ, রাজকাঁকড়া, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ প্রায় ১,০৭৬ প্রজাতির জীববৈচিত্র্যের নিবাস সেন্টমার্টিন।
অতিরিক্ত পর্যটন ও আবর্জনা দূষণের কারণে এই প্রজাতিগুলোর অনেকই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়েছিল।
তবে এবার সরকার আশাবাদী—
“যদি সবাই নিয়ম মেনে চলে, তাহলে সেন্টমার্টিন আবারও পরিবেশবান্ধব পর্যটনের আন্তর্জাতিক উদাহরণ হয়ে উঠবে।”
উপসংহার
সেন্টমার্টিন শুধুমাত্র একটি পর্যটন গন্তব্য নয়—এটি বাংলাদেশের গর্ব, একটি জীবন্ত প্রতিবেশ।
দ্বীপটির বেঁচে থাকা মানে সামুদ্রিক প্রকৃতির বেঁচে থাকা, এবং সেই দায়িত্ব এখন সবার—পর্যটক, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজের।
যদি আমরা আজ থেকে দায়িত্বশীল হই, তাহলে হয়তো আগামী প্রজন্মও দেখতে পাবে সেই নীল জলের নিচে দুলতে থাকা প্রবাল, উজ্জ্বল শামুক-ঝিনুক আর দৌড়ানো লাল কাঁকড়ার স্বর্গভূমি।