দেশে আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস থেকে চালু হচ্ছে মোবাইল ফোন নিবন্ধনের বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা ‘ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (NEIR)’। এর আওতায় দেশে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি মোবাইল ফোনকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে।
বুধবার (২৯ অক্টোবর) রাজধানীর বিটিআরসি ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব। উপস্থিত ছিলেন বিটিআরসির চেয়ারম্যান এমদাদুল বারী এবং মহাপরিচালক আমিনুল হক।
নিবন্ধনের লক্ষ্য: নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা
সরকারের দাবি, এনইআইআর চালুর মূল উদ্দেশ্য হলো চুরি, প্রতারণা ও ক্লোন ফোন ব্যবহারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
ফয়েজ তৈয়্যব বলেন,
“১৬ ডিসেম্বরের আগে দেশের নেটওয়ার্কে যেসব ফোন আছে, সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধনের আওতায় চলে আসবে। কোনো ফোন ক্লোন বা অবৈধ হলেও আপাতত বন্ধ হবে না; বরং ‘গ্রে লিস্ট’-এ রাখা হবে।”
এর ফলে ব্যবহারকারীর হ্যান্ডসেট ও সিম উভয়ই সরকারি ডাটাবেজে নিবন্ধিত থাকবে। একাধিক সিম ব্যবহার করা যাবে, তবে হ্যান্ডসেটটি যার নামে নিবন্ধিত থাকবে, শুধুমাত্র তার সিমই সেখানে ব্যবহার করা যাবে।
গ্রাহকের দুর্ভোগের আশঙ্কা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন এই ব্যবস্থায় পুরনো ও ক্লোন হ্যান্ডসেট ‘ডিরেজিস্ট্রেশন’ (deregistration) বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কারণ, কেউ যদি নিজের পুরনো ফোন বিক্রি করেন বা অন্য কাউকে দেন, তাহলে সেটি ব্যবহারের আগে ‘ডিরেজিস্ট্রেশন’ করতে হবে।
ফয়েজ তৈয়্যব সতর্ক করে বলেন,
“মূল চ্যালেঞ্জ হবে এনইআইআর চালুর পর মানুষের দুর্ভোগ কমানো। কোটি কোটি ব্যবহারকারীর হাতে থাকা ফোনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাই আমরা ধীরে ধীরে, ‘মাইল্ড’ভাবে প্রক্রিয়াটি শুরু করছি।”
‘ডিরেজিস্ট্রেশন’ প্রক্রিয়া কীভাবে চলবে
বিটিআরসির মহাপরিচালক আমিনুল হক জানিয়েছেন, ‘ডিরেজিস্ট্রেশন’ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে নথিভিত্তিক।
“ফোনের মালিক মারা গেলে বা বিদেশে গেলে আত্মীয়রা তার এনআইডি বা পাসপোর্টের শেষ চার ডিজিট জানলেই সেটি ‘ডিরেজিস্ট্রেশন’ করা যাবে।”
তবে ক্লোন হ্যান্ডসেটের ক্ষেত্রে ঝামেলা বাড়বে। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে জানাতে হবে, ফোনটি ডিরেজিস্ট্রেশনের পর কোন সিম ব্যবহার করা হবে।
এমদাদুল বারী জানান,
“একই আইএমইআই নম্বরে এক লাখ ফোন পাওয়া গেছে—এটা ভয়াবহ সমস্যা। এজন্য প্রক্রিয়াটি ধীরে, সতর্কভাবে চালাতে হবে।”
‘গ্রে লিস্ট’ ও ‘ব্ল্যাক লিস্ট’ ব্যবস্থা
এনইআইআরের সার্ভারে তিনটি তালিকা থাকবে—হোয়াইট, গ্রে ও ব্ল্যাক লিস্ট।
-
হোয়াইট লিস্ট: বৈধ, অনুমোদিত ফোন।
-
গ্রে লিস্ট: ক্লোন বা সন্দেহভাজন ফোন, আপাতত চালু থাকবে।
-
ব্ল্যাক লিস্ট: অবৈধ ও অপরাধে ব্যবহৃত ফোন, যা নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হওয়া বন্ধ হবে।
এই ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সাইবার সুরক্ষা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্বেগ
বিটিআরসি চেয়ারম্যান এমদাদুল বারী বলেন,
“সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গেলেই সাধারণ মানুষের জীবনে কিছুটা চাপ আসে। কিন্তু এই চাপই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“আমরা ১৬ ডিসেম্বর থেকে কঠোরভাবে নয়, বরং খুব মৃদুভাবে প্রক্রিয়াটি শুরু করব। ধীরে ধীরে ‘রশিটা টাইট’ করব, যেন মানুষ সময় পায়।”
ক্লোন ফোন ও বাজারের প্রভাব
বিশ্লেষকদের মতে, এনইআইআর কার্যকর হলে চোরাই ও ক্লোন ফোনের বাজার ধস নামবে। তবে সাধারণ ক্রেতারা পুরনো হ্যান্ডসেট বিক্রি বা বদল করার সময় সমস্যায় পড়তে পারেন।
মোবাইল ব্যবসায়ী সমিতির এক সদস্য বলেন,
“আমরা নীতিটিকে স্বাগত জানাই, কিন্তু গ্রাহককে জটিলতা থেকে বাঁচাতে অনলাইন ‘ডিরেজিস্ট্রেশন’ সিস্টেমটা সহজ করতে হবে।”
সচেতনতার আহ্বান
সরকার বলছে, গ্রাহকদের সচেতনতা ও সহযোগিতা ছাড়া এই বিশাল প্রকল্প সফল হবে না। শিগগিরই টেলিকম অপারেটর ও মোবাইল বিক্রেতাদের মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু হবে।
সমাপ্তি:
এনইআইআরের মাধ্যমে একদিকে মোবাইল নেটওয়ার্কে স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা বাড়বে, অন্যদিকে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন কোটি গ্রাহক। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির এই পথে মানবিক দিকটি কতটা রক্ষা করা যায়—সেটিই এখন দেখার বিষয়।