তাণ্ডবে বিপর্যস্ত ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ
প্রবল ঘূর্ণিঝড় হারিকেন মেলিসা ক্যারিবীয় অঞ্চলে তাণ্ডব চালিয়ে গেছে। জ্যামাইকা ও হাইতিতে অন্তত ২৪ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় দুপুরে জ্যামাইকা উপকূলে আছড়ে পড়ে ক্যাটাগরি–৫ মাত্রার এ ঝড়। এরপর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ হাইতি, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র ও কিউবায়।
ঝড়ের ফলে জ্যামাইকার বেশির ভাগ উপকূলীয় অঞ্চল পানির নিচে চলে গেছে, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। দেশটির জরুরি সেবা সংস্থাগুলো জানায়, ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাবই ছাড়িয়েছে ২ হাজার ২ কোটি মার্কিন ডলার, যা জ্যামাইকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) চেয়েও বেশি।
সরকারের প্রতিশ্রুতি ও ত্রাণ কার্যক্রম
জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্ড্রু হলনেস বলেছেন,
“আমরা দেশের প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে আছি। পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে রাষ্ট্রের সর্বশক্তি ব্যয় করা হবে।”
সরকারের পক্ষ থেকে সেনা, পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা মানুষদের উদ্ধারে হেলিকপ্টার ও উদ্ধার নৌকা ব্যবহার করা হচ্ছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাগুলোও জ্যামাইকা ও হাইতিতে জরুরি সহায়তা পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিভাগ (OCHA) ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে প্রাথমিকভাবে ৫০০ টন ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।
হাইতিতে প্রাণহানি ও মানবিক বিপর্যয়
সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে হাইতিতে। দেশটিতে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং শতাধিক মানুষ আহত। রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বহু ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে, স্কুল ও হাসপাতাল পানিতে তলিয়ে গেছে।
ঝড়ের পর পানির উৎস দূষিত হয়ে পড়ায় কলেরা ও ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে হাইতির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জরুরি সতর্কতা জারি করেছে।
বাহামা উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে মেলিসা
বর্তমানে হারিকেন মেলিসা কিছুটা দুর্বল হয়ে ক্যাটাগরি–৩ মাত্রায় নেমে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হারিকেন সেন্টার (NHC) জানিয়েছে, এটি এখন বাহামা উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং সেখান থেকে বারমুডা দ্বীপে আছড়ে পড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গত এক দশকের মধ্যে এটি সবচেয়ে বিধ্বংসী ঝড়গুলোর একটি। এর তীব্রতা প্রমাণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান ট্রপিকাল সাইক্লোনের হুমকি এখন বাস্তব।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ
আবহাওয়া বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে ক্যারিবীয় অঞ্চলে সমুদ্রের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। এতে ঘূর্ণিঝড়গুলোর শক্তি ও স্থায়িত্ব দুটোই বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞ ড. মারিয়া স্যান্ডারসন বলেন,
“প্রতি বছরই ঝড়ের তীব্রতা বাড়ছে। এটি শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি একটি মানবিক সংকটও।”
জাতিসংঘ জলবায়ু দপ্তর (UNEP) বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলবায়ু অভিযোজন ব্যয়ের ঘাটতি থাকায় এই ধরনের বিপর্যয়ে ক্ষতি বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে।
মানবিক সহায়তার আহ্বান
হাইতি ও জ্যামাইকায় এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে জরুরি সহায়তার আহ্বান জানানো হয়েছে।
রেড ক্রস, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (WFP) ও ইউনিসেফ ক্ষতিগ্রস্ত শিশু ও পরিবারদের জন্য জরুরি ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে।
সমাপ্তি:
হারিকেন মেলিসা শুধু জ্যামাইকা বা হাইতির বিপর্যয় নয়, এটি গোটা মানবতার জন্য এক সতর্কবার্তা। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব এখন আর ভবিষ্যতের বিষয় নয়—এটি এখনকার বাস্তবতা।